আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৯
চট্টগ্রাম ওয়াসা একটি রাষ্ট্রীয় অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যার মূল কাজ হলো নগরীতে পানি ও পয়ঃপ্রণালী সেবা নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও সংস্থাটি নাগরিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বর্তমানে নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটারের বিপরীতে তারা সরবরাহ করতে পারছে মাত্র ৩৬ কোটি লিটার। সে কারণে নগরীর একটি বড় অংশে এখনো রয়েছে পানির তীব্র সংকট। চট্টগ্রাম ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা ৭১ হাজার ১৩০ জন। তার মধ্যে ৬৪ হাজার ১৯ জন আবাসিক আর ৭ হাজার ১১১ জন বাণিজ্যিক। গত ২৮ জুন ২০১৯ চট্টগ্রাম ওয়াসার সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম পানির বিলে অব্যবস্থাপনা ও বিড়ম্বনা রোধে চট্টগ্রাম ওয়াসার সব কার্যক্রম অটোমেশনের (স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি) আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় মন্ত্রী ও সচিব কীভাবে এ ধরনের একটি প্রস্তাব দিলেন, এর পেছনে কী যুক্তি কাজ করেছে তা অনুমান করা না গেলেও হয়তো সরকারি কর আহরণই মুখ্য হতে পারে বলে অনেকেই মতপ্রকাশ করেছেন। তবে শুধু কি পানির দাম বাড়ালেই ওয়াসার রাজস্ব বাড়বে? নাকি তলাবিহীন ঝুড়ির পথ বন্ধ করতে হবে তা বড় প্রশ্ন। দেশের ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মনে করে, চট্টগ্রাম ওয়াসার অদক্ষ প্রশাসন, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মীয়করণ বন্ধ করা গেলে তলাবিহীন এই ঝুড়ি চট্টগ্রামবাসীকে অনেক সেবা দিতে সক্ষম হবে। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর বর্তমান সরকারের আমলেই ১৩ হাজার কোটি টাকার সর্বোচ্চ উন্নয়ন বরাদ্দ পেলেও বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুর্নীতির জন্য কারাবাস ভোগকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ১০ বছরেও প্রশাসনে গতিশীলতা আনতে পারেননি। অধিকন্তু গত ২৫ মে ২০১৯ ওয়াসার ৫১তম সভায় বলা হয়, গড় বিল আদায়ের কারণে ৩৮ শতাংশ গ্রাহক পাঁচগুণ বেশি বিল প্রদান করার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন হলে ওয়াসার বোর্ড সদস্য জাফর সাদেককে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাই ওয়াসার অভ্যন্তরে অনিয়ম, গড়বিল আদায়ের মতো পুকুরচুরি, পানি উৎপাদন কেন্দ্রে প্রকৃতপক্ষে কত লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে তার প্রকৃত সত্যতা যাচাই করার জন্য ওয়াসার ডাটাবেস ছাড়াই উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে পানি উৎপাদন ও বিতরণে ডিজিটাল মিটার না থাকায় পানির প্রকৃত উৎপাদন খরচ নিয়ে শুভংকরের ফাঁকির মতো ঘটনাগুলোকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। ক্যাবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে গড়বিল আদায়, বিল আদায়ে নানা অনিয়ম তুলে ধরলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেদিকে কোনো কর্ণপাত করেনি। আবার দীর্ঘদিন ধরে এই বিপুল পরিমাণ বিল আদায়কারীদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিতে পারেনি। উপরন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের আগেই পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তদন্ত কমিটির পুরো কাজটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা বলে মনে করি। অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানি ও পয়ঃপ্রণালী উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসার অদক্ষ, অদূরদর্শী নেতৃত্ব, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মীয়করণের কারণে নগরবাসী কোনো সুফল পায়নি। অধিকন্তু পুরো নগরে পানির জন্য হাহাকার, নগরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, পানির লাইনের লিকেজ ও বিপুল পরিমাণ পানি প্রতিদিন নালা-নর্দমায় পড়ে অপচয় হচ্ছে। নগরীর একটি বড় অংশে পানির জন্য হাহাকার, ময়লা ও দুর্গন্ধময় পানি সরবরাহ, হালিশহর এলাকায় খাবার পানির লাইনে সুয়ারেজের লাইন যুক্ত হয়ে পানি দূষণে গত বছর জন্ডিসসহ পানিবাহিত রোগ মহামারী আকার রূপ নিলেও ওয়াসা কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক যে, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী নগরের চাহিদার প্রায় ৮৩ শতাংশ পানি ওয়াসা সরবরাহ করছে। কিন্তু ওয়াসার হিসাব শাখার তথ্যানুযায়ী মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গ্রাহক সার্বক্ষণিক পানি পাচ্ছেন। বাকিরা নিয়মিত পানি পান না। আবার চট্টগ্রাম ওয়াসা দাবি করছে, পানির উৎপাদন দৈনিক ৩৬ কোটি লিটার। যার কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। কারণ রাঙ্গুনিয়ায় শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার ও পাম্প হাউজে কোনো ডিজিটাল মিটার নেই। ফলে প্রকৃতপক্ষে কত লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে, তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। আর নগরীর দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটার হলে, আরো ১৫-২০ কোটি লিটার হয় অপচয় হচ্ছে, না হলে পানি চুরি হচ্ছে। তাই পানি উৎপাদন ও বিতরণে ডিজিটাল মিটার না থাকায় পানির প্রকৃত উৎপাদন খরচ নিয়ে শুভংকরের ফাঁকির সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬ অনুসারে চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের প্রতিনিধি এবং পানি ব্যবহারকারী ভোক্তাদের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসায় গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে যিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন, তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের তল্পিবাহক রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদার, যার মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হলেও গত চার বছরে নতুন গ্রাহক প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অধিকন্তু ভোক্তা প্রতিনিধি মনোনীত করার বিধানও মানেনি কর্তৃপক্ষ। সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। যেখানে ধারা নং ৫-এর ১৬ উপধারায় বলা আছে, ক্যাব দেশের সর্বত্র ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। আর তারই ধারাহিকতায় ক্যাব সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী ও কমিটিগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করে এলেও চট্টগ্রাম ওয়াসায় এই আইন মানা হচ্ছে না। গ্রীষ্মকাল শুরুর প্রাক্কালে পুরো চট্টগ্রাম নগরজুড়ে যখন পানির জন্য হাহাকার, তখন চট্টগ্রাম ওয়াসার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্যস্ত ছিলেন ওয়াসার ঠিকাদারদের অর্থায়নে আয়োজিত কোটি টাকার ওয়াসা নাইট আয়োজনে। নগরবাসীর অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এ ধরনের আচরণ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। এটি গ্রাহক স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড। ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া, ঠিকাদারদের অর্থায়নে এ ধরনের আয়োজন শুধু অনৈতিক নয়, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ক্ষমতাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। কারণ যাবতীয় নীতি ও পরিকল্পনা ওয়াসার বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার কথা। যদি অনুমোদনের প্রয়োজন না পড়ে তাহলে বর্তমান বোর্ড অকার্যকর ও তারা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়। আর ওয়াসার তহবিল থেকে যদি অর্থ ব্যয় না হয়ে থাকে তাহলে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। বর্তমান সরকারের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক একাধারে ১০ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে বয়স, কর্মক্ষমতার কারণে ওয়াসাকে কিছুই দিতে পারেননি। তিনি ১৯৬৮ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালে পূর্ণ মেয়াদ শেষে অবসরে যান। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতির মামলা হয়েছিল যা এখনো চলমান এবং তাকে দুর্নীতির কারণে কারাবাস করতে হয়েছিল। ফলে স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও বোর্ডকে উপেক্ষা করে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তার একগুঁয়েমির কারণে অদ্যাবধি উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) নিয়োগ আজো সম্পন্ন হয়নি। তাই পানির অপচয় রোধ, সরবরাহ লাইনে ত্রুটি, লিকেজ, পানি চুরি বন্ধ, বিলিং ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করে সেবা সার্ভিসের অব্যবস্থাপনা রোধে গ্রাহকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, গ্রাহকসেবার মান ও অনিয়ম রোধে ত্রিপাক্ষিক গণশুনানির আয়োজন করা, গ্রাহক হয়রানি রোধে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য ডিজিটাল হেলপলাইন চালু ও হেলপ ডেস্ক আধুনিকায়ন, দাম বাড়ানোসহ সেবার মান উন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়নে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ঋণ ও ভর্তুকিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের চেয়ে গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হতে হলে সত্যিকার গ্রাহকদের কাছে জবাবদিহি করা ও গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা অর্থের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলেই দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১