বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

নদীগুলো বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ইটিপি, এসটিপি স্থাপন প্রয়োজন


প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি তোলা হয় ভূগর্ভ থেকে? সাধারণত ভূগর্ভস্থ পানিই আমাদের পানের উপযোগী পানি। এই পানের উপযোগী বিশুদ্ধ পানি তুলেই ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কল-কারখানায়। মুহূর্তের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি হয়ে যাচ্ছে দূষিত। শুধু দূষিত বললে ভুল হবে, মারাত্মকভাবে দূষিত এ পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যমতে ঢাকার নদীগুলোতে ভারী ধাতুর সংখ্যা দিন দিনই বেশি হয়ে যাচ্ছে। একটি স্বাভাবিক বিষয় হলো, নদীগুলো সব একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত। ঢাকার নদীর বিষাক্ততা একসময় ঢাকার বাইরের নদীগুলোকে বিষাক্ত করে ফেলবে এটা খুবই সাধারণ চিন্তা। গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জের নদীগুলো সবচেয়ে বেশি দূষিত। সাভারে ইপিজেড থাকলেও নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ইপিজেডের কোনো কার্যকারিতা নেই। ভারী ভারী সব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কেমিক্যাল শিল্পও রয়েছে। বিশেষ করে টেক্সটাইলের মধ্যে কম্পোজিট ফ্যাক্টরিগুলোর পানি বেশি পরিমাণ দূষিত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় ফার্মাসিউটিক্যালের বর্জ্য পানি। গাজীপুরের বিভিন্ন খালের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায় পানির pH, TSS, DO, BOD সবগুলো স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

এসব এলাকার অনেক জায়গায়ই নলকূপের পানির pH ৬-এর নিচে চলে আসছে অনেক সময়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় বেশিরভাগ কোম্পানিই ইটিপি সঠিকভাবে চালায় না বা কোনো কোনোটির ইটিপি নাইও। অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা তাদের ব্যবহূত দূষিত পানি রাতের বেলা সরাসরি প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য ইটিপি ব্যবহার না করে পরিবেশের অবস্থা নাজুক করে ফেলছে এই রক্তচোষা কোম্পানিগুলো!

এই পানির রংও যথেষ্ট কালো এবং দুর্গন্ধযুক্ত। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির বর্জ্য হওয়ার কারণে অনেক সময়ই সালফারের গন্ধমিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দূষিত হতে থাকলে নদী দূষণ অনেক বেশি বেড়ে যাবে। খালগুলোর পানিতে মাছসহ কোনো ধরনের জলজ প্রাণী বর্তমানে পাওয়া যায় না এবং পানি পান করলে কুকুর অনেক সময় সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এত দূষিত পানিতে জলজ প্রাণী বাঁচার কোনো অবস্থাই নেই। তুরাগ নদের দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কালো পানির সঙ্গে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে যা কিনা মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকির কারণ।

নদীগুলোর এমন দূষণ কমানো সম্ভব এবং তা একটু সচেষ্ট হলেই। যে কোম্পানিগুলো ইটিপি ব্যবহার করছে, তাদের ব্যবহার সঠিক উপায়ে করাতে হবে এবং যারা করছে না তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইটিপি তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই সরকারিভাবে প্রতিটি শিল্পাঞ্চলের জন্য সেন্ট্রাল একটি করে ইটিপি তৈরি করতে হবে। এই সেন্ট্রাল ইটিপিগুলো অবশ্যই যেখানে ময়লা পানিগুলো গিয়ে পড়ছে, সেই খালের ময়লা পানি পড়ার স্থানে করতে হবে। যদি কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিপি তৈরি করা যায় তবে অবশ্যই পানি দূষণ কমানো সম্ভব। এর সঙ্গে জিরো ডিসচার্জ প্ল্যান্টের জন্যও উদ্যোগী হতে হবে আমাদের। যে পানি ব্যবহার হচ্ছে, সে পানিকে পুনরায় ব্যবহারের পদ্ধতিকে জিরো ডিসচার্জ বলা হয়। যদি এই সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাও হবে বড় ধরনের সাফল্য।

বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর অনেকগুলো উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু মূল যে কাজটি তা হলো, সবাইকে বোঝানো কেন আমরা ইটিপি ব্যবহার করব এবং কোন ধরনের ইটিপি ব্যবহার করলে সবদিক দিয়েই সাশ্রয়ী হতে পারে। কিছুদিন আগেও বেশিরভাগ কোম্পানি কেমিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করত। কেমিক্যাল ইটিপি ব্যবহারের কারণে দেখা যেত প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যাল খরচ হচ্ছে। এক মিটার কিউব পানিকে দূষণমুক্ত করতে আটাশ থেকে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত লেগে যেত। এ কারণে অনেক কোম্পানিই ইটিপি ব্যবহার করতে চাইত না অথবা ইটিপি থাকলেও তা সঠিকভাবে চালাতে চাইত না। বর্তমানেও অনেক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট আছে তবে মুখ্য কারণ ওটাই, সেটা হলো- বেশি টাকা খরচ হয় বলেই তারা ইটিপি চালায় না।

অথচ বায়োলজিক্যাল ইটিপিগুলোতে অনেক কম খরচে পানি দূষণমুক্ত করা যাচ্ছে বা যায়। প্রতি কিউব মিটার পানি দশ টাকার নিচেও দূষণমুক্ত করা সম্ভব। যেহেতু বায়োলজিক্যাল প্ল্যান্টে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না সুতরাং পানির মানও অনেক ভালো হয়ে থাকে। স্থাপনের সময় যে টাকা প্রয়োজন হয়, সে টাকার পরিমাণ বেশি হলেও পরে কিন্তু তেমন খরচ ছাড়াই পানি পরিশোধন করা সম্ভব হয়। আর এ বিষয়গুলোই জানে না এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানের লোকেরাই।

সরকারের এখানেও কাজ করার আছে অনেক। যারা নতুন প্রতিষ্ঠান করছে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে বায়োলজিক্যাল ইটিপি তৈরি করতে। প্রয়োজনে সরকারের এ খাতে ঋণের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, আমি আবারো বলছি সরকারের বিভিন্ন খালের শেষভাগে এসে সেন্ট্রাল ইটিপিও নির্মাণ করতে হবে। নদীর পানি ব্যবহারের জন্য উদ্যোগী হতে হবে। কাজ করতে হবে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট নিয়েই। অর্থাৎ পানিকে বাঁচানোর জন্য জরুরি যত পদক্ষেপ আছে তা এখন থেকেই নিতে হবে দ্রুতগতিতে। 

পানি ভূগর্ভ থেকে তোলা হয় তার মানে এই নয়, এটা উঠতেই থাকবে সারা জীবন। মিঠাপানি কমে আসছে। জনস্বার্থে কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) তৈরিতে সরকারের উদ্যোগী হতে হবে এখনই। এর সঙ্গে ভাবতে হবে এসটিপি নির্মাণের বিষয়টিও। কারণ হাসপাতালগুলো কোনো রকম ট্রিটমেন্ট ছাড়াই তরল বর্জ্য ছেড়ে দিচ্ছে পরিবেশে, যা খালের মাধ্যমে গিয়ে পড়ছে নদীতে। একটি পৌরসভাও এখনো পুরোপুরিভাবে চালু করতে পারেনি এসটিপির ব্যবহার। দূষণ হচ্ছে এভাবেও বিভিন্ন নদীর পানি।

আমরা পরিবেশ নিয়ে ভাবলে এখনো শুধু বায়বীয় পরিবেশ নিয়েই বেশি ভাবি। সে হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের কথা চিন্তা করলেও জলজ পরিবেশ নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি অমনোযোগিতা রয়েছে আমাদের। তার প্রমাণ গত বছর হাওরে মাছের মৃত্যু এবং মাছ কমে যাওয়া। বাঁচতে হলে বিশুদ্ধ পানির সংরক্ষণ করতেই হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি পরিবেশ উপযোগী শিল্পনীতি ও তার বাস্তবায়ন। শিল্প মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এ বিষয়ে বিস্তর কার্যকর পদক্ষেপ আশা করছি।

 

লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১