বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৯

রাঙ্গা এখন জাপার ‘বিষফোড়া’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা ফাইল ছবি


নিজ দলের মহাসচিব এখন দলের জন্য বিষফোড়া। গোলাপ ফুল, ধানের শীষসহ একাধিক দল বদল করে এই পার্টিতে ঢুকেছেন সুচ হয়ে, ধারণ করেছেন ফালের আকৃতি। হাতুড়ি ঠুকে পেরেক মেরেছেন মিত্রদের দেয়ালে। চলার পথে বিছিয়েছেন কাঁটা। তাকে নিয়ে বেকায়দায় খোদ পার্টির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তিনি মশিউর রহমান রাঙ্গা। এমপি থেকে মন্ত্রী হয়ে ফের এমপি তিনি। জাকের পার্টি থেকে শুরু করে বিএনপি পেরিয়ে এখন জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় প্রধান এই ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যটা কী? হিসাব-নিকাশ চলছে তার রাজনৈতিক আমলনামা নিয়ে। হিসাবটা তার নিজ দলের মতো রাজনৈতিক জোটেও। তার অপ্রত্যাশিত বক্তব্য, মন্তব্য আর আচরণের দায় নিতে চাচ্ছেন না দলীয় নেতারা। বহিষ্কারের দাবি উঠেছে নিজ দলেই। সংবিধান পরিপন্থী, গণতন্ত্রবিরোধী বক্তব্য এবং শপথ ভঙ্গ করার অপরাধে অভিশংসনের মাধ্যমে রাঙ্গার সংসদ সদস্য পদ শূন্য করে আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে দলের বাইরে। চলছে আন্দোলন। একগুচ্ছ বেফাঁস কথা বলে দু-একটির জন্য ক্ষমা চেয়ে শেষ রক্ষা হবে না— এমন মন্তব্য করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর রাঙ্গার মতিগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয়। তিনি বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, সর্বশেষ নূর হোসেনকে নিয়ে রাঙ্গার বক্তব্য দলের নয়। নিতান্তই তার ব্যক্তিগত। জয় বলেন, ভিন্ন দল থেকে আসা রাঙ্গা সাহেব কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পল্লীবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিকে জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

গত রোববার জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া দীর্ঘ বক্তব্যে পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রে পেরেক মেরেছেন, এরশাদ গণতন্ত্রের ধারক-বাহক ছিলেন। গুলিতে ১৮ কৃষক নিহত হয়েছেন, তাহলে খালেদা জিয়া (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) স্বৈরাচার। আর খালেদা জিয়া স্বৈরাচার হলে হাসিনাও (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) স্বৈরাচার। গণতন্ত্র পাউডার, তেল বা ফেসওয়াশ নয়।’ এ সময় তিনি বলেন, ‘দেশে এক মহিলা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোপাচ্ছেন।’ এরশাদ সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তাকে (নূর হোসেন) নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নাচানাচি করে।’

তার বক্তব্যের পরপরই ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। ’৯০-এর আন্দোলনকারী সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, রাস্তায় নেমে আসে নূর হোসেনের ‘মা’সহ পরিবার। রংপুরে তার বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করেছে ক্ষুব্ধ জনতা। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোতে কড়া প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গা স্বৈরাচার এরশাদের প্রেতাত্মা। তাই নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি করছেন। তাকে সংসদ থেকে অপসারণের দাবিও জানান নব্বইয়ের এই ছাত্র নেতা।

তোপের মুখে রাঙ্গা সংবাদ সম্মেলন করে নূর হোসেনের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন। দাবি করেছেন নূর হোসেন ইয়াবাখোর... কথাগুলো মুখফসকে চলে এসেছে। কিন্তু তাতে ক্ষোভ কমেনি সংক্ষুব্ধদের।

নূর হোসেনের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইলেও জনগণ বিচার করবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বহু ঘটনার নায়ক মশিউর রহমান রাঙ্গা ১৯৫৮ সালের ২২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ গুপ্তপাড়ায়। শিক্ষাজীবনে তিনি বিকম ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি পরিবহন মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির’ সভাপতি। রাঙ্গা রংপুরে ‘গণি মিয়া’ হিসেবে খ্যাত। কারণ ওই আসনে তার নিজস্ব কোনো ইমেজ নেই। বিভিন্ন দল ত্যাগ করে জাপায় এসে এরশাদের আপন ভাগ্নেকে সরিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপি এবং পরে মন্ত্রী হয়েছিলেন পরিবহন ব্যবসায়ী রাঙ্গা। ২০০১ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এর আগে ’৯০-এর দশকে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাকের পার্টি দিয়ে তার রাজনীতি শুরু। তিনি এরশাদের ভাগ্নে হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। অথচ আপন ভাগ্নে নন রাঙ্গা। পার্টিতে নানামুখী ভূমিকার কারণে তিনি দফায় দফায় অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে দলের দীর্ঘসময়ের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে পদ থেকে সরানো হলে শূন্যস্থানে বসেন রাঙ্গা। চাউর ছিল পরিস্থিতি তৈরির নেপথ্যে ছিলেন এই ব্যক্তিটি। এদিকে এরশাদের মৃত্যুর পরও ‘বরের ঘরে মাসি আর কনের ঘরে পিসি’ ভূমিকায় নামেন এমপি রাঙ্গা। ছিলেন বিরোধে লিপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের পক্ষেও। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে ক্ষোভ আছে।

গত রোববার বঙ্গবন্ধু, প্রধনমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘আমি জাপার মহাসচিব। আমি যা বলি, দলের পক্ষেই বলি। আমার কি ব্যক্তিগত কোনো বিষয় আছে? নূর হোসেনের সঙ্গে তো আমার জমিজমা সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা ছিল না।’ তবে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও বিস্ময় প্রকাশ করছি। যার অবদানে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন পতাকা পেয়েছে তাকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য অমার্জনীয় অপরাধ। প্রয়াত পল্লীবন্ধু এরশাদ ও পল্লীমাতা রওশন এরশাদ ওনাকে সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলেন।

রাঙ্গা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে পার্টিকে ‘সানাই ঝঞ্ঝাট’ পোহাতে হয়েছে। শর্টফ্লিমের অভিনেত্রী ও মডেল সানাই মাহবুব ইউটিউবে বলেছিলেন, তিনি সরকারের একজন এমপি এবং সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে তার বাগদান হয়েছে। একটি হোটেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ফিতা কেটেছিলেন ওই প্রতিমন্ত্রী। তখন থেকেই পরিচয়, ফোন নম্বর আদান-প্রদান এবং শেষ পরিণতিতে বিয়ে হয়েছে বলে দাবি ছিল সানাইয়ের। ওই ব্যক্তিটি তার আগের স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। দুটি সন্তানও রয়েছে। এ নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হয় রাজনৈতিক অঙ্গন, বিনোদন পাড়া থেকে শুরু করে গ্রামের চায়ের দোকান পর্যন্ত। যে যার মতো নাম-পদবি সাঁটাতে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সর্বত্র আলোচনায় উঠে আসে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার নাম। অথচ রাঙ্গা বলেন, সানাই আবার কে?

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১