বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২০

নদীদূষণ রোধে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ


বাংলাদেশ হাজার নদীর দেশ। তবে ঠিক কতটি নদী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে নেই।  কোন কোন নদী থেকে খালের উৎপত্তি হয়েছে। এই হিসাব করলে আমাদের দেশকে হাজার নদীর দেশ বলা যেতে পারে। যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে রয়েছে অজস্র নদী। কোন কোন নদীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এরপর আসে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী ইত্যাদি নদ-নদীর নাম। এসব নদীর মধ্যে কোনটা বড়, কোনটা ছোট বলা কঠিন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ দেশে ১২শ নদ-নদীর নাম পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ২৩০টির নাম আছে। যদিও বাস্তবে সবগুলো সচল নেই।

নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর, বন্দর, গঞ্জ, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিনিয়তই বাড়ছে নদীদূষণ। আমাদের পানির উৎস মূলত তিনটি। আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ, বৃষ্টি ও ভূগর্ভস্থ পানি। এর মধ্যে নদীপ্রবাহের অবদান দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৭৬.৫ ভাগ), বাকি দুটির অবদান যথাক্রমে ২৩ ভাগ ও ১.৫ ভাগ। ভূগর্ভস্থ পানির কথা ধরলে, বর্তমানে দেশের ৯০ ভাগ সেচকাজ পরিচালিত হয় অগভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে। গত ৩৫ বছরে পানির স্তর নেমে গেছে ৪ ফুট। কয়েক কোটি মানুষ আর্সেনিকঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। নদীগুলোর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সমুদ্রের নোনাপানি ১৮০ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে। পৃথিবীর সুপেয় পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তাই অনেকের মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে এই সুপেয় পানির জন্য।

বাংলাদেশ সুপেয় পানির এক অমূল্য ভান্ডার। পৃথিবীর মোট সুপেয় পানির ১৭ ভাগ আছে বাংলাদেশে। এর যথাযথ ব্যবহার করে আমরা নিজেদের অনেক উন্নতি করতে পারি। অথচ এই সম্পদ ব্যবহারে কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই। আমাদের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে এবং পানিসম্পদকে রক্ষা করতে না পারলে আমাদের অবস্থা হবে ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ গল্পের মতো। নদীগুলো দিয়ে বছরে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কত, পানিপ্রবাহ ও নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের ধারণক্ষমতার ভারসাম্য কতটুকু, এই পানির কতটুকু সাগরে যায়, আর কতটুকু সেচ-গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় ব্যবহার করি; নৌপরিবহনসহ মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য নদীর নাব্য কতটুকু প্রয়োজন; নদীভাঙন, বন্যা ও খরা রোধ করার জন্য কী করণীয়; ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কত; নদীগুলো দিয়ে কী পরিমাণ পলি আসে এবং সেগুলোর কী গতি হয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সমন্বিত সমীক্ষার মাধ্যমে যে মহাপরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল, আজ পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যেটা হচ্ছে, তা অন্ধের হাতি দেখার মতো। তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিস্থিতির জটিলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ঢাকা শহরের পর্যাপ্ত স্যানিটেশনব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়ঃবর্জ্যের প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। টঙ্গী, বাড্ডা প্রভৃতি অঞ্চলের বর্জ্য চলে যাচ্ছে বালু ও তুরাগে। বুড়িগঙ্গার দূষণমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নদীর পাশ দিয়ে হাঁটা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত এই দূষণের ফলে রাজধানীর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। মানুষের স্বাস্থ্য এখন হুমকির সম্মুখীন। দূষণের ফলে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে, তার শতকরা ৮৬ ভাগই ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে তোলা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় নগরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে নদীর তীর বা আশপাশের বসবাসকারী লোকজন গোসল, রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করায় ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।  বলা বাহুল্য, নদী দখল ও দূষণ রোধে সরাসরি দায়িত্ব প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের আওতায় রয়েছে নদীর পানি দূষণ রোধ করা। প্রতিদিন ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিন, নানা ধরনের অ্যাসিড দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগাম অ্যালকালি-মিশ্রিত বর্জ্যের কারণে নদীগুলো প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। লাখ লাখ মানুষ পরিবেশদূষণের শিকার হয়ে জন্ডিস, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালি, কিডনি, চর্মরোগসহ ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। এসব নদীর পানি ব্যবহারকারী বেশির ভাগ মানুষই চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও উপযোগী আইনি কাঠামোর প্রয়োজন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিজ নিজ এলাকার দূষণ ও পরিবেশ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর তালিকা প্রণয়ন করতে হবে এবং শিল্প-বর্জ্য দ্বারা ভূপৃষ্ঠস্থ পানির দূষণ রোধের উদ্দেশ্যে জরুরি ভিত্তিতে নদীর তীরবর্তী সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনব্যবস্থার স্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশ ও নদী রক্ষার লক্ষ্যে সংঘটিত ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছা ও সহযোগিতারও প্রয়োজন জরুরি বলে মনে করছি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ

ভাকোয়াদী, কাপাসিয়া, গাজীপুর


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১