বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২০

কিরণরেখার পত্রপুট


শহীদ ইকবাল

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 

রাস্তার কোনায় বটগাছ আর তার পাশের ওদিকটায় আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া—শাখাচ্যুত কলি ঝরাতে থাকে; পায়ে হাঁটা পথের এদিক-ওদিক মাড়িয়ে নির্বিকার মানুষজনও চলাফেরা করে। সকলেই গরিবের গরিব। উচ্চাশার জোয়ারে তখন কেউ ধনী তেমন নয়। চাহিদার স্বল্পতাও অভ্যাসের অন্তর্গত। তবে এর মাঝে বাড়াবাড়ি রকমের একটা বড়বাড়ি থাকে— সেটা বেশ ছড়ানো। বনেদি বড়বাড়ির কোনো একজন বাইরে পড়েন। শোনা যায়, কদিন হলো তিনি এসেছেন। ওখানে পাতা চেয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কসবাদ নিয়ে কমবেশি কথাবার্তা শুরু করেন। আমাদের কাছে তখন ব্রেজনেভ এক বিশেষ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। লম্বা দশাশই চেহারা আর ক্রেমলিন মার্কা অভিজাতপ্রবণ স্বরধ্বনি আমাদের মনের জানালায় অভিঘাত ফেলে। অর্থহীন কিন্তু স্বপ্নসাধের সেই সঙ্গ তখন কোথায় যেন সমীহ জাগায়, সত্যচিত্ত ছুঁয়ে যায়। তবে এইরকম রাজনীতির টুকটাক সাড়াশব্দ ধারায় আমরা বঙ্গবন্ধুকেও খুঁজি কিন্তু তিনি ‘নাই’ থাকেন, ঘরে-বাইরে মুরুব্বীরা কেউই তখন তেমন একটা এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না! খাওয়া-পরা বা আস্থাশীল সামন্ত আঁচড়হীন মুগ্ধ জীবনযাপন তখন সবার প্রিয়। একটিমাত্র ছোট্ট টেলিভিশনে সিনেমার গান কোনো ধারাবাহিকে টকঝাল কিছু চলতিপথে সংক্ষিপ্ত বিলোড়ন তোলে। তা ছিল শুধু ব্যাটারিতে পোষা ওই টেলিভিশনে মানুষের ম্যাজিকদৃষ্টির তুচ্ছ বিনোদনমাত্র। ‘নির্বাসিত বঙ্গবন্ধু’ কথাটা হয়তো এখন অনেকেই বলেন কিন্তু তখন ছিল না। দুএকবার কৃষ্ণচূড়ার তলায় রিফিউজির পানের দোকানে ‘শ্যাখ সাহেব’ কথাটা কানে এসে ঠোকা দেয়, খুব দুর্বল সে ধ্বনি। যে ছেলেটা অঙ্কে ভালো— সে একসময় বাইরের শহরে চলে যায়। তাকে আর কাগজ কিনতে দেখা যায় না। বেশ ভোরের অন্ধকার থাকতে একদিন কুয়াশার একুশের ভোর রাতে শীতল আবহাওয়ার ভেতরে গান গেয়ে থানাপাড়ার অনেকগুলো ছেলের সাথে সেও জড়ো হয়। ছেলেটাকে তখন আবিষ্কার করা যায়। কেবলই সে দিনভর জার্নি করে চব্বিশ মাইল পার হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে, মায়ের দুধমাখা ভাত খাওয়ার আশায়। তবে সেদিন খেলাঘরটা মাতিয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকে কেন্দ্র করে। কেউ পড়ে, কেউ গায়, কেউবা ছবি বিশ্বাসের মতোন অভিনয় করে। তাই নিয়ে পূর্ণ ছিল সে রোদনভরা বসন্ত। ওখানে ঠিকপাশের বকুলগাছ দুটা কাছাকাছি জড়ানো-মেশানো— ঘন; গায়ে গা ঠেসে টান-টান শাখায় পরস্ফুিটিত। ওসব কুড়িয়ে মালা হয়। যেন খেলার পুতুলের মতোন যত্নে সাজানো এইসব পাড়া-গাঁ। থানাপাড়ার বড় বাড়িটায় দ্লধারী বড়বাবুদের ক্বচিৎ দেখা যায়। লম্বা আকৃতির— খাঁকি পরা আর হাতে তার পরিষ্কার জ্বলজ্বলে ছিপছিপে শালতি নৌকোর মতোন চলনশীল শান্ত দণ্ড। তিনি থাকেন স্থির। ভয় আর শিহরণ ঘেরা সবটা। হাতে সেই চকচকে হাতের ছড়ি। আহা! কী তার মোহন রূপ! রিজার্ভড। ঠিক কোর্টের হাকিমের কটকটে বজ্রকঠিন মুখশ্রী যেন। আজকাল পুলিশে আর ওসব আছে কী! সবটা কোথায় যেন তলানো— ভুষুৎ!!!

 

আমাদের দোকানের কাগজ বিক্রির কাজটা পছন্দ না হলেও আয়-অর্থ আর লাভ দরকার ছিল। একটা সকালে দোকানটা খোলার আগেই চোখে পড়ে রাস্তার ওই পাশে শ্যাওলা পড়া কিঞ্চিৎ ফাটা স্কুলদেয়ালে মোটা শাদা হরফে লেখা— ‘জেনারেল ওসমানীকে ভোট দিন’। পুরো একটা দেয়ালজুড়ে তা ভর্তি ছিল। বেশ গোটা গোটা লেখা। এমন থোকা থোকা বড় শাদা কালির লেখা কখন কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো, আশ্চর্য! কারা এসব করে? রাত জাগা বা অন্ধকার রাতের কাজ যে এটা— সেটা কঠিন মনে হয়। বেশ পরে দেয়াললিখনের এ কারুকর্ম সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জেনে যাই। তখন তো বেলা অনেক, কিশলয় ফুটে কৈশোরিক হাসি মিলিয়ে গেছে কোন্ দিগন্তে। পাশ ফেরা তুলনামূলক বয়স্ক কেউ একজন তখন বলেছিল, ‘ওসমানিক ভোট না দিলে আবার গন্ডগোল হবে!’ গন্ডগোল বা যুদ্ধ দূর-অতীতের ভয় নয় তখন, সহসাই সমস্যার মুখে পড়া গত পাঁচ-ছয় বছর আগের ভয়ই ছিল তখন সর্বত্র। ‘গন্ডগোলের বছর’ কথাটা সকলের রপ্ত। প্রায়ই শোনা যায়। এ নিয়ে তখন চেতনাসূচক কিছু কেউ বলেন না। যেন সহজ কথা সহজে বলা। তবে পাকবাহিনী বললে ঘৃণার স্বরটা বোঝা যায়। ‘পাকবাহিনী মারছে’— ‘পাকবাহিনিক রান্না করি খাওয়াইছে আর মোটা মোটা শক্ত টিনের বান ঘরে তুলছে’— ‘পাকবাহিনীর লাত্থি-গুঁতা খায়াও থাকছে... তারা লাভবান হইছে’ ইত্যাদি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ব্যক্তি, এখন যিনি সর্বত্র কারণে-অকারণে পূজিত হচ্ছেন, বিবেচিত হচ্ছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে অতুল্য, বাহ্যিক বহিরাঙ্গনে শোভময়, বহুব্যাপ্ত অতিরঞ্জিত সর্বদা যিনি— তিনি ঘুণাক্ষরেও কোথাও ছিলেন না তখন। যে পোস্টমাস্টার এলাকায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, একরকম প্রশাসকও বটে; আরো ছিলেন বড়বাবু, সার্কেল অফিসার, হেডমাস্টার, টিইও এদের চেয়ে আরো বড় ডিস্ট্রিক্ট জাজ, প্রিন্সিপাল সাহেব, ডিসি সাহেব, ডিও সাহেব— সবাই ভালোরকম সরকারের ‘দাস’ ছিলেন, তবে এমন দাসত্বে তাদের প্রজাতান্ত্রিক সততা ছিল, সদ্যগঠিত প্রজাতন্ত্রের কর্মঠ প্রতিনিধির অংশীদার ছিলেন তারা। অঙ্গুলি-সংকেতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তাদের কোনো দ্বিধা-সংশয় ছিল না। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে বিন্দুমাত্র নাক গলাতে চাইতেন না। পদমর্যাদা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠাও অভিন্ন তখন, মর্যাদাও গড়ে ওঠে ওই একই মাত্রায়, মাথা উঁচু করে থাকে সব; স্বতঃস্ফূর্ত সমীহও পান তারা। কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয় না— এসব সরকারি অফিসারদের। তাদের বংশ-বুনিয়াদ নিয়েও ছিল না কোনো প্রশ্ন! একটা চল ছিল, বংশগুণ ছাড়া কেউ বড় চাকরির যোগ্য নন। মুরব্বিদের কথায় গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু, জিন্নাহ, লালপ্রসাদ শাস্ত্রী রেফারেন্স হতেন বারবার। অনেক স্বশিক্ষিত ব্যক্তিও এরকম উচ্চতাস্পর্শীদের নাম ব্যবহার করে চলতেন, নিজেদের সামাজিক পরিচয় মজবুত করার জন্য। বক্তা ও শ্রোতা সম্পর্ককেন্দ্রে যোগ্যতার পরিচয় নির্ধারিত হতো, এসব নামের ভেতর দিয়ে। ভাইরালগ্রস্ত শ্রোতৃমণ্ডলী তখন তাদের যোগ্যতার পরিমাপ শুরু করতে থাকেন। লেজেন্ডদের কথা বললে যেন সহজেই লেজেন্ডারি হওয়া যায়— এরকম একটা ব্যাপার। পাঞ্জাবি সামন্ত ভূস্বামীদেরও গুণগান চলে তখন। এসব ধারায় ট্রটস্কি, লেনিনও থাকতেন। আরো শোনা যেত রুজভেল্ট-কেনেডি, বার্ট্রান্ড রাসেলের নাম। শিহরণসূচক নাটকীয়তা এসব ব্যক্তির পরিবেশনা মুগ্ধ করে দেয় শ্রোতাদের, যে জ্যেষ্ঠ এসব বলতেন তিনি ছিলেন ‘জান্নেঅলা’। সেভাবেই মুখর সমাজে সম্মাননীয় হতেন তারা। কারো আচরণে কোন্ সরকার রাষ্ট্র চালায় তা লেশমাত্র বোঝার উপায় নেই। এখন মনে হয়, রাজনীতি বা রাষ্ট্র কেউ কী বুঝতেন তখন? সেটা সেই ধূসর গ্রামীণ সমাজে ওসব অভাবনীয় যেন। আজকাল যে কল্পনার অতীত এমনটা— কাজ আর কাজের তৃপ্তি, এখনকার ঠিক বিপরীত। কারণ সেই নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের ‘উদ্ভবে’র আবেগ ‘বিকাশে’র চাকায় ‘নিঃশেষে প্রাণ’সুলভ গতির বেগ কবেই যেন অতলে হারিয়ে গিয়েছিল। ‘জাতির জনক’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কথাটাও গণমানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়নি। সে পরিচর্যার সর্বমুখ বঞ্চিতই থেকে গেছেন তিনি। তবু মনে হয়, মুষলপর্বের অন্তহীনতার সূত্রে ‘জাতির জনক’ শব্দসমষ্টি সবার কাছে সমাদৃত না হওয়ায় অজানা দুঃখই রয়ে যায়। হয়তো তিনি ভুলে আমাদের দুঃখ দিয়েছিলেন, তাঁর শাসনামলে কিন্তু সেই অঙ্ক-কষা কাগজ কেনা বালকটির স্বপ্ন তো তিনিই বুনে দিয়েছিলেন— এই স্বাধীন দেশে, সেখানে আমাদের ব্যক্তিগত দুঃখ কি খুব বেশি ছিল?

 

চলবে


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১