বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২১

নেক আমলে অনীহা : কারণ ও প্রতিকার


মুহাম্মাদ আবু আখতার

 

 

 

মুমিন জীবনে নেক আমলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নেক আমল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাব যাই হোক প্রতিটির আলাদা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতলাভের জন্য ঈমানের সঙ্গে নেক আমলও অপরিহার্য। এরপরও নেক আমলের ব্যাপারে আমরা অনেকে চরম অবহেলা প্রদর্শন করি। নেক আমল করতে আমাদের অনেকের কাছে একদম ভালো লাগে না। নেক আমলে অনীহা আমাদের জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনে। নেক আমলে অনীহার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দশটি কারণ এবং এগুলোর প্রতিকার জেনে আমলে আগ্রহ সৃষ্টির উপায় সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

এক. তাকওয়ার অভাব : নেক আমলে অনীহার প্রধান কারণ তাকওয়ার অভাব। যার অন্তরে তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় আছে, সে নেক আমলে অনীহা প্রদর্শন করতে পারে না। তাকওয়া মানুষের অন্তরে আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভয় সৃষ্টি করে। এর ফলে নেক আমলে আগ্রহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তাকওয়া মানুষের অন্তরে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি করে এবং সত্যপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে বলেন, ‘যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে।’ (সুরা আল-আরাফ, আয়াত-২০১) অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তবে তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন এবং তোমাদের থেকে তোমাদের পাপকে সরিয়ে দেবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহর অনুগ্রহ অত্যন্ত মহান।’ (সুরা আনফাল, আয়াত-২৯)

দুই. ইলমের অভাব : বিভিন্ন নেক আমলের অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। এসব অনেকেই জানে না। ফলে এসব আদায়ের নিয়মপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ ইলম অর্জনেও তারা কোনো চেষ্টা করে না। আর ইলম ছাড়া সঠিকভাবে নেক আমল আদায় করা সম্ভব নয়। এর ফলে নেক আমলেও তাদের অনীহা দেখা যায়। এছাড়া জ্ঞানহীনদের হূদয়ে আল্লাহতায়ালা মোহর মেরে দেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এমনিভাবে আল্লাহ জ্ঞানহীনদের হূদয় মোহরাঙ্কিত করে দেন।’ (সুরা রুম, আয়াত- ৫৯) তাই নেক আমলে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জনের বিকল্প নেই। কওমের কিছু লোকদের দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে অন্যদের সতর্ক করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।, (সুরা তাওবা, আয়াত- ১২২)

তিন. আখেরাতের ব্যাপারে গাফলতি : আখরাতে নেক আমলের সুফল এবং নেক আমলে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে অনেকে সচেতন নয়। আখেরাতের ব্যাপারে তারা চরম গাফেল। আবার অনেকে আখেরাতের জীবন বিশ্বাসই করে না। এর ফলে নেক আমলেও তাদের তেমন আগ্রহবোধ পয়দা হয় না। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহংকার প্রদর্শন করেছে।’ (সুরা নাহল, আয়াত-২২)

 

চার. অসৎসঙ্গীর প্রভাব : অসৎসঙ্গীর প্রভাবেও নেক আমলে অনীহা সৃষ্টি হয়। অসৎসঙ্গী নেক আমলের পথে বড় প্রতিবন্ধক। অসৎসঙ্গীর প্রভাবে অনেক সৎ ছেলেও বিপথগামী হয়ে যায়। তাই সৎ লোকদের সঙ্গে থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১১৯) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা অসৎ সঙ্গ গ্রহণ করে তাদের আফসোসের কোনো সীমা থাকবে না। অসৎ সঙ্গ গ্রহণকারীর আফসোস সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হায় আমার দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-২৮)

পাঁচ. গোনাহের প্রভাব : গোনাহের দ্বারা অন্তর প্রভাবিত হয়। গোনাহের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায় অন্তরে এর কুপ্রভাব তত বেশি পড়ে। যে অন্তর গোনাহের কাজে মজা অনুভব করে সে অন্তরে নেক আমলের আগ্রহ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাওবা না করে অনবরত গোনাহ করতে থাকলে একসময় নেক আমলের প্রতি আগ্রহ একদম কমে যায়। তখন নেক আমল করতে আর ভালো লাগে না। গোনাহ মানুষের হূদয়ে মরিচা ধরায়। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কখনও না, বরং তারা যা করে, তা-ই তাদের হূদয় মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।’ (সুরা মুতাফফিফীন, আয়াত-১৪)

ছয়. পরিবেশের প্রভাব : মানুষ পরিবেশের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। অনেককে দেখা যায়, ভালো কোনো পরিবেশে থাকলে নেক আমলের ব্যাপারে বেশ ভালো আগ্রহ থাকে। কিন্তু খারাপ পরিবেশে সেই আগ্রহ একদম থাকে না। পরিবেশ সবসময় অনুকূল হবে না। তাই বলে কি আমরা প্রতিকূল পরিবেশের অজুহাতে নেক আমল ছেড়ে দেব? অবশ্যই আমরা তা করব না। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে পরিণত করার জন্য যথাযথ চেষ্টা করা। পরিবেশ পরিবর্তনের চেষ্টা সফল না হলে অন্যত্র অনুকূল পরিবেশে যেতে হবে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারি করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহতায়ালার আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও বিদ্রূপ হতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়। তা না হলে তোমরাও তাদেরই মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ দোযখের মাঝে মুনাফেক ও কাফেরদেরকে একই জায়গায় সমবেত করবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৪০)

সাত. শয়তানের কুমন্ত্রণা : শয়তানের প্রধান কাজই হলো মানুষের অন্তরে নানা ধরনের কুমন্ত্রণা ঢেলে দেওয়া। শয়তানের কুমন্ত্রণা মানুষকে নেক আমল হতে উদাসীন করে রাখে। এজন্য সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকতে হবে। যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় শয়তান তাদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেওয়ার সুযোগ পায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে।’ (সুরা যুখরুফ, আয়াত-৩৬, ৩৭)

আট. নফসের কুপ্রোরচনা : মানুষের নফস নেক আমলের জন্য কোন ধরণের কষ্ট স্বীকার করতে চায় না। এজন্য নেক আমলের ব্যাপারে সে চরম অবহেলা প্রদর্শন করতে চায়। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা হজরত ইউসুফ (আ.) এর উক্তি বর্ণনা করেন, ‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত-৫৩)

নয়. মন্দ লোকের সমালোচনা : সমাজে কিছু কুলাঙ্গার আছে যারা কাউকে নেক আমল করতে দেখলেই তার সমালোচনা শুরু করে। অনেক ভীতু লোক সমালোচনার ভয়ে নেক আমলের ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করে। কারো সমালোচনা ও উপহাসকে তোয়াক্কা না করে নেক আমল করে যেতে হবে। কেননা সব নবী-রাসুলের সাথেই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়েছিল এবং তাদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এর কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘এমনিভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোনো রাসুল আগমন করেছে, তারা বলেছে : জাদুকর, না হয় উম্মাদ।’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৫২)

দশ. দুনিয়ার মোহ : মানুষের নেক আমলে গাফলতির অন্যতম প্রধান কারণ দুনিয়ার মোহ। অনেকে দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে পরকালকে বেমালুম ভুলে যায়। সেই সাথে নেক আমলের প্রতি সামান্যতম আগ্রহও তার থাকে না। তাই দুনিয়ার মোহ হতে বাঁচতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে।’ (সুরা তাকাছুর, আয়াত-১) যারা আখেরাতের চেয়ে দুনিয়ার জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেয় তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘যারা পরকালের চাইতে পার্থিব জীবনকে পছন্দ করে; আল্লাহর পথে বাধা দান করে এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করে, তারা পথ ভুলে দূরে পড়ে আছে।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত-৩)

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১