আপডেট : ০৭ মে ২০২১
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা যে কোনো সময় বলে জানা গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা ও লন্ডনে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও দলটির নেতারা বলছেন, সরকার অনুমতি দিলেই পরবর্তী প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করবেন তারা। ইতোমধ্যে তাদের সব রকম প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি আন্তরিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) জন্য আবেদন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্টের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আবেদনকারীর স্বাক্ষর থাকা বাধ্যতামূলক হলেও খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেই ‘শর্ত শিথিল’ করা হয়েছে। জানা গেছে, খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের ফি জমা দেওয়া হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সেটি দেওয়া হবে। ২০১৯ সালে পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তার পক্ষে আবেদন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট পাবেন। একটি সূত্র জানায়, বিদেশ নেওয়ার অনুমতি পেতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেন খালেদা জিয়ার পরিবার। সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর গত বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন জমা দেন। পরে আবেদনপত্রটি পর্যালোচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে নিজের বাসায় গণমাধ্যমকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে দ্রুতই জানানো হবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে আবেদনের সিদ্ধান্ত আজ নয়, তবে দ্রুতই জানানো হবে। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত, সরকারের নির্বাহী আদেশে গত বছর ২৫ মার্চ মুক্তি পান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরপর তার মুক্তির মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছিল সরকার তাতে শর্ত ছিল তিনি বিদেশে যেতে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। এখন তাকে বিদেশ যেতে হলে সরকারের নির্বাহী আদেশের শর্ত শিথিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকার সেই শর্তটি শিথিল করলে খালেদা জিয়ার বিদেশে যেতে আইনগত কোনো বাধা থাকে না। এটা নির্ভর করছে একেবারেই সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। অন্যদিকে, বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হচ্ছে না। পুরো প্রক্রিয়াটি লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দলীয় কোনো কোনো নেতা বিষয়টিতে সরাসরি যুক্ত থাকলেও উদ্ধৃত হতে অনিচ্ছুক। সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার পরিবার চাচ্ছে তাকে যে কোনভাবে বিদেশে নিয়ে যেতে, যাতে পুত্রবধূ ডা. জুবায়দা রহমান সরাসরি তার চিকিৎসার দেখভাল করতে পারেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, আগে ম্যাডাম বাসায় ছিলেন, এখন হাসপাতালে। স্বজনরা কীভাবে তার শারীরিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন আমি বলতে পারব না। এছাড়া খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব আব্দুস সাত্তার বলেন, বাসায় থাকতে ডা. জুবায়দা রহমানের তত্ত্বাবধানে ম্যাডামের চিকিৎসা চলছিল। এখন হয়তো ডাক্তারদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় জড়িত এক চিকিৎসক বলেন, ম্যাডাম বাসায় থাকতে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একজন ছিলেন ডা. জুবায়দা রহমান। তখন তিনি নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত থাকতেন। আর ম্যাডাম হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে যে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন হয়েছে সেখানে আমাদের তিনজন (ডা. এফ এম সিদ্দিকী, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. আল মামুন) ডাক্তার আছেন। এখন আমরা নিয়মিত ডা. জুবায়দা রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনিও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার আপডেট নেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মায়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতিতে চাইলেও এই মুহূর্তে পরিবারের কেউ দেশে আসতে পারছেন না। তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা চাইছেন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে। সেটা লন্ডন বা সিঙ্গাপুর যেখানেই হোক। তবে তারা লন্ডনকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ, সেখানে নেওয়া হলে পুত্রবধূ ডা. জুবায়দা রহমান নিজেই চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে থাকতে পারবেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার অবস্থা অপরিবর্তিত আছে। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার চেস্ট দেখছেন। কিছু ট্রিটমেন্ট এডজাস্টমেন্ট করেছেন। সেই অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলছে।’ গত সোমবার সকালের দিকে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে চিকিৎসকরা খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে স্থানান্তর করেন। এভারকেয়ার হাসপাতালের হূদরোগ বিশেষজ্ঞ শাহাবুদ্দিন তালুকদারের তত্ত্বাবধানে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। প্রসঙ্গত, ৭৫ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুই মামলায় দ্লিত। প্রায় আড়াই বছরের মতো কারাগারে ছিলেন তিনি। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে পরিবারের আবেদনে সরকার গত বছরের ২৫ মার্চ ‘মানবিক বিবেচনায়’ শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেয়। দুই দফায় এ মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় আজ শুক্রবার বাদ জুমা সারা দেশে মসজিদে দোয়া মাহফিল ও বিভিন্ন উপাসনালয়ে প্রার্থনা সভার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ১১ এপ্রিল খালেদা জিয়ার করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও ২৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। পরদিন তার চিকিৎসার জন্য ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। গত ৩ মে বিকালে তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তাকে নিয়মিত অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জানা যায়, খালেদা জিয়া করোনা নেগেটিভ হয়েছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, ম্যাডামকে লন্ডন নেওয়া হলে পুরো যাত্রা অনেক দীর্ঘ। সেক্ষেত্রে তার অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। আর এই যাত্রা তার শরীরের জন্য কতটা নিরাপদ হবে, তাও বিবেচনায় রয়েছে। এর আগে গত বুধবার রাতে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার তার বোনের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি নিয়ে যান। পরে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, সরকার ইতিবাচকভাবেই বিষয়টি বিবেচনা করছে। পরে রাতেই চিঠিটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় মতামতের জন্য। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে সে চিঠি আইনমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, প্রক্রিয়াটি যাচাই করা হবে। আজ কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। দেশের একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল বিকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি এখনো বলছি, আন্তরিক হই আর যা-ই হই প্রথম হচ্ছে-মানবিক কারণে সরকার দণ্ডাদেশ স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই আন্তরিক। কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে তো আমরা যেতে পারি না। আইন বিবেচনা করে করতে হবে।’ সেক্ষেত্রে কেমন সময় লাগতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘যথাশিগগিরই এটা আমরা করবো।’ উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান খালেদা জিয়া। সেখান থেকে এক মাসের মধ্যেই ফেরার কথা থাকলেও চিকিৎসার জন্য বেশি সময় লাগায় তার দেশে ফিরতে দেরি হয়। পরে ওই বছর ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবায়দা রহমান ও তাদের মেয়ে জাইমা রহমান। আর ২০১৭ সাল থেকে লন্ডনে আছেন ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান এবং তার দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান। দলটির শীর্ষ নেতারা জানান, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ছেলে, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে অনলাইনে ভিডিও কলের মাধ্যমে নিয়মিত কথাবার্তা ও গল্প-আড্ডা হতো খালেদা জিয়ার। গত ১১ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের একজন ছিলেন পুত্রবধূ ডা. জুবায়দা রহমান। তখনো নিয়মিত খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভিডিওকলে যোগাযোগ হতো ডা. জুবায়দাসহ স্বজনদের। কিন্তু গত ২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার সঙ্গে স্বজনদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিএনপির দলীয় ডাক্তার এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেন তারা।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১