বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৮ মে ২০২১

ঘণ্টায় তিন ফিলিস্তিনি শিশু হামলার শিকার


মুহুর্মুহু বিমান হামলা। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যে স্বজনদের মৃতদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষ। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের অব্যাহত হামলার কারণে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় এমন চিত্র দেখছে বিশ্ব। কিন্তু এ হামলা বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি জাতিসংঘ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও হামলা বন্ধের আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছেন না ইসরাইল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামলা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। আর তাকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। খবর : বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।

গাজা উপত্যকায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের চালানো হামলায় প্রায় ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৯২ জনই নারী-শিশু (৩৪ নারী ও ৫৮ শিশু)। সে হিসাবে নিহতদের ৪৭.৯২ শতাংশই নারী ও শিশু। ইসরাইলের বোমা হামলা শুরুর পর প্রতি ঘণ্টায় তিনজন করে নিষ্পাপ শিশু হামলার শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছে শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিন কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন লি বলেছেন, গত এক সপ্তাহে গাজায় অন্তত ৫৮ শিশু এবং ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে দুই শিশু নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলায় গাজায় ৩৬৬ শিশুসহ সহস্রাধিক ফিলিস্তিন আহত হয়েছেন।  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আর কতগুলো পরিবার তাদের প্রিয়জনকে মরতে দেখবে? নিজের ঘরে যখন বিমান হামলা চলে তখন এসব শিশু কোথায় পালিয়ে তাদের জীবন বাঁচাবে? গাজার অনেক পরিবার ও আমাদের কর্মীরা জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতি দেখে তাদের হূদয় ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা নরকে বাস করছে। পালিয়ে আশ্রয় নেবেন এমন কোনো জায়গা নেই। এটার কোনো শেষও দেখছেন না তারা। 

ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর গত রোববার ছিল ভয়াবহ দিন। এদিন ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলায় ১৬ নারী, ১০ শিশুসহ ৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। শিশুসহ একদিনে এত মৃত্যু গত এক সপ্তাহে হয়নি। হামাস জানিয়েছে, রোববারের হামলায় লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে সংগঠনটির উপত্যকাপ্রধান ইয়াহইয়া আল-সিনওয়ারের বাড়িকেও। গতকাল সোমবারও বেশ কয়েকটি বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। গুঁড়িয়ে দেয় দুটি আবাসিক ভবন।

ভোররাতে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো গাজা সিটির বেশ কয়েকটি এলাকায় ৮০ বার বিমান হামলা চালিয়েছে, হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে এক পশলা রকেট ছোড়ার পর এসব হামলা চালানো হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, মধ্যরাতের একটু পর ইসরাইলের বীরশেবা ও আশকেলন শহরে গাজা থেকে রকেট হামলা চালানোর পর তাদের জঙ্গি বিমানগুলো সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। তাৎক্ষণিকভাবে সীমান্তের কোনো পাশ থেকে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। 

এদিকে গাজায় জ্বালানি সংকট দেখা দিচ্ছে আর এ কারণে ফিলিস্তিনি ছিটমহলটির হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থাপনাগুলো বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। মধ্যপ্রাচের শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য নিয়োজিত জাতিসংঘের বিশেষ উপ-সমন্বয়কারী ল্যান হেস্টিংস জানিয়েছেন, জাতিসংঘকে জ্বালানি ও অন্যান্য সরবরাহ পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য তিনি ইসরাইলের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এটি নিরাপদ হবে না বলে তাকে জানানো হয়েছে।

ধসে পড়া ভবন ও বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত মানুষ ও মরদেহের খোঁজে তল্লাশি-উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে গাজা বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী। হামলার ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন হাজারো পরিবার। তার পরও প্রাণে রক্ষা পাচ্ছে না।

সংঘাত বন্ধের আন্তর্জাতিক আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক এই অভিযান পুরোদমে চলছে। যত দিন প্রয়োজন তত দিন তা চলবে। প্রয়োজনে হামলা জোরদারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ইসরাইলি হামলার জবাবে গাজা থেকে এক সপ্তাহ ধরে ছোড়া রকেটে দুই শিশুসহ ১০ ইসরাইলি নিহত হয়েছে বলে দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। গাজার বেসামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে ইসরাইলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সপ্তম দিনে সংস্থাটি এ নিন্দা জানাল। রোববার ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এক ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে মুসলিম দেশগুলো এ নিন্দা জানায়। 

ওআইসির পক্ষ থেকে অবিলম্বে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, এ হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ ঘোষণার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাসের মুসলিম ঐতিহ্য ও স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে যেকোনো হামলা এবং ফিলিস্তিনি জনগণ ও মুসলিম বিশ্বের অনুভূতিতে উসকানিমূলক আঘাত হানার ব্যাপারে তেল-আবিবকে সতর্ক করেছে। এ ছাড়া সেখানে সে রকম কিছু ঘটলে তার পরিণতি ইসরাইলকে বহন করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বিবৃতিতে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করে বলা হয়, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে ইসরাইল সেখানে একটি বর্ণবৈষম্যমূলক প্রথা চালু করেছে।  বায়তুল মুকাদ্দাস ও আল-আকসা মসজিদ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের রেড লাইন এবং এগুলোর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ইসরাইল স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তার আশা করতে পারে না।

এদিকে ইসরাইল সরকারের কাছে অস্ত্রের চালান সরবরাহে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন ইতালির বন্দর শ্রমিকরা। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সেনারা বর্বর আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রেক্ষাপটে অস্ত্র চালান সরবরাহে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ইতালির পত্রিকা কন্ট্রোপিয়ানো জানিয়েছে, অস্ত্রের একটি চালান ইসরাইলে যাচ্ছে এমন তথ্য পাওয়ার পর ইতালির লিভোরনো শহরের বন্দর শ্রমিকরা তাতে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন।

অস্ত্রভর্তি কয়েকটি কন্টেইনার জাহাজে তুলে দেওয়ার জন্য বন্দর শ্রমিকদের টিপস দেওয়ার পর শ্রমিকরা জানাতে পারে যে, এসব কন্টেইনার ইসরাইলের বন্দরনগরী আশদোদে যাবে। এসব কন্টেইনারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল। পত্রিকাটি লিখেছে, ওইসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক ফিলিস্তিনি জনগণকে হত্যার জন্য ব্যবহূত হবে।

অন্যদিকে পশ্চিম তীর, গাজা এবং ইসরাইলে চলমান হামলার বিষয়ে কাতার, মিসর ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। রোববার দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, ইসরাইল এবং পশ্চিম তীর ও গাজায় শান্তি ফিরিয়ে এনে জনজীবনের করুণ ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মেদ বিন আবদুলরহমান আল-থানির সঙ্গে আলোচনা করেছেন ব্লিনকেন।

এ বিষয়ে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদে প্রার্থনারতদের ওপর হামলার বিষয়ে কথা বলেছেন তারা। গাজা এবং পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও তারা জানিয়েছে।

মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে ব্লিনকেন বিবদমান পক্ষগুলোকে চলমান এই সংকট এবং ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে তার অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর সৌদি আরবের সরকারি গণমাধ্যম এসপিএ জানায়, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সেখানে ফিলিস্তিন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিরাজমান সংকট সমাধানে সম্ভাব্য পদক্ষেপের বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন তারা।

চলমান হামলা বন্ধের জন্য ইসরাইল ও হামাসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন একাধিক মার্কিন সিনেটর। এ ক্ষেত্রে জনজীবনের অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি এবং ভবিষ্যত হামলার প্রেক্ষাপট যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ডেমোক্রেটিক সিনেটর ক্রিস মার্ফি এবং রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়ং। যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একই ধরনের কথা বলেছেন আরো ২৫ জন ডেমোক্রেটিক এবং দুজন স্বতন্ত্র সিনেটর।

মুসলিম বলে ঘৃণা করে : ইসরাইলের মুহুর্মুহু বিমান হামলায় তাদের বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। চোখের সামনে বোমাবর্ষণে স্বজন-প্রতিবেশীর মৃত্যু দেখছে গাজার ১০ বছর বয়সি শিশু নাদিন আবদেল-তাইফ। এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানোর ক্ষমতা তার নেই। ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে সে বলছে, ‘কী করব আমি? আমার কী ক্ষমতা আছে?’ নাদিনের ওই কান্নার ভিডিও এখন অনলাইনে ভাইরাল।

এখন পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলায় অন্তত ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৪১ জনই শিশু। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, গাজায় ৬ বছর বয়সের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যদিও সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলার বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ ইসরাইল। ইসরাইলেও দুই শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার মধ্যে একজনের বয়স ৬ বছর।

ভিডিওতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডিল ইস্ট আইকে ছোট্ট নাদিন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘কী করব আমি, বলুন? ওই ধ্বংসস্তূপ সরাবো? আমার সত্যিই ভয় করছে। আমার স্বজনদের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। কিন্তু কী করা উচিত এখন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই যাতে লোককে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এখন কিছুই করতে পারছি না। আমি যখনই এসব দেখি, আমার কান্না পায়। শুধু ভাবি, কেন আমাদের ওপরেই হামলা হচ্ছে? বাড়ির লোকেরা বলে, আমরা মুসলিম বলে ওরা আমাদের ঘৃণা করে। এখানে এত শিশু থাকে। কেন শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে ওরা? এটা অনুচিত।’


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১