বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২১

ক্লু-লেস মামলা তদন্তে সফল পিবিআই


চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থাগুলো যেখানে হাল ছেড়ে দেয়, সেখান থেকেই কাজ শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যাত্রার পর থেকে বিভিন্ন মামলার রহস্যজট উন্মোচন করে বার বার আলোচনায় এসেছে সংস্থাটি। যেসব মামলার কোনো সূত্রই থাকে না, অর্থাৎ ক্লু-লেস অনেক মামলার তদন্তেও সফলতা দেখিয়েছে পিবিআই।

জানা যায়, ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৯৭০ জন জনবল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে ২০২০ জন জনবল নিয়ে মোট ৪২টি জেলায় পিবিআইর ৪৯টি ইউনিট কাজ করছে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকে পিবিআইর ইউনিটগুলো জিআর ও সিআর মামলা তদন্ত করছে। একজন ডিআইজির নেতৃত্বে পিবিআই পরিচালিত হয়। অপারেশনাল কার্যক্রম অনুসারে পিবিআইকে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল- এ দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। দুজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে এ দুটি অঞ্চল পরিচালিত হয়। এছাড়া কাজের সুবিধার্থে পুরো বাংলাদেশকে আটটি অপরাধ বিভাগ, জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকা মিলে ৭৪টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিট একজন পুলিশ সুপার দিয়ে পরিচালিত। পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সের অধীনে এসআইঅ্যান্ডও, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, সিটিইউ ও অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট পরিচালিত হয়।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৩ হাজারেরও বেশি মামলা। এর মধ্যে আদালতে দায়ের করা মামলা রয়েছে ৫০ হাজার ৫৫৪টি। থানায় দায়ের করা মামলা ১২ হাজার ৪৯৮টি। মুলতবি বা চলমান মামলা রয়েছে থানার (জিআর) দুই হাজার ৪১৬টি, সিআর (আদালত) মামলা চার হাজার ৮৯৭টি। এর মধ্যে ১ হাজার ২২৭টি হত্যা মামলা। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই আদালতের নির্দেশে তদন্ত করা। জানা যায়, ২০১৫ সালের ১০ জুন থেকে মামলা তদন্তে নামে সংস্থাটি। তবে বিধিমালা অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নামে তারা। হত্যা, সাইবার অপরাধ, প্রতারণাসহ ১৪ ধরনের ক্লুলেস মামলার তদন্তে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন পিবিআই কর্মকর্তারা। তবে আদালতের নির্দেশে জমিজমার বিরোধ, হত্যার হুমকিসহ সাধারণ ঘটনার তদন্ত করে এই ইউনিট। পিবিআইয়ের অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবে যুক্ত ফিঙ্গার প্রিন্টের প্রযুক্তিতে প্রায় দুই শ অজ্ঞাতপরিচয় লাশের পরিচয় শনাক্ত করে মৃত্যুর রহস্য জানা গেছে। মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের মুছে ফেলা তথ্য পুনরুদ্ধার করছেন তদন্তকারীরা। ফরেনসিক ওয়ার্কস্টেশনে (অত্যাধুনিক ল্যাপটপ) বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে যে কোনো ল্যাপটপ থেকে যে কোনো তথ্য বের করা হয়। ফরেনসিক ইমার্জিং সিস্টেম টিডিথ্রি সরঞ্জাম ব্যবহার করে যে কোনো হার্ডডিস্ক থেকে তথ্য উদ্ধার করা হয়। সার্ভার ও কম্পিউটারে থাকা অসংখ্য তথ্যের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত তথ্য খুঁজে দেয় ডাটা রিকভারি স্টিক।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছেন তদন্তকারীরা। প্রথম হত্যা মামলার বাদী বাবুলের মতোই অনেক মামলায় বাদীকে পরে আসামি বলে শনাক্ত করেছে পিবিআই। গত বছর সিলেটে চাঞ্চল্যকর রায়হান হত্যায় এসআই আকবরকে গ্রেপ্তারের পর চার্জশিট দিয়েছে। সে রায়হানের বিচারও শুরু হয়েছে। এমনই অর্ধশত মামলায় পুলিশের সদস্যদেরই অপরাধ প্রমাণ করেছে পিবিআই। ২০১৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় জড়িত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ৩৩ কার্যদিবসে চার্জশিট দেয়। গত বছর ঘটনার ২৪ বছর পর প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। রাজধানীর রমনায় ৩০ বছরের আগের সগীরা মোর্শেদ হত্যা মামলার আসামি শনাক্ত করে গত বছর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই ইউনিট। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় সময়মতো অক্সিজেন না দিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে সংগঠনের ৪৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পিবিআই।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘তদন্ত করাই আমাদের কাজ। আমরা একযোগে বড় টিম নিয়ে সঠিক সময়ে, সঠিক ট্রাকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এই পথে প্রযুক্তি ও টিম ওয়ার্কের সঙ্গে বড় যে শক্তি তা হলো প্রশ্ন তৈরি করার ক্ষমতা। আমরা মনে করি যত বেশি প্রশ্ন করার ক্ষমতা, তত বেশি উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা। তদন্ত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এই প্রশ্ন তৈরির দক্ষতা বাড়ানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘অন্যতম কৌশল হলো কেস স্ট্যাডি নিয়ে ব্রিফিং। ক্লুলেস মামলার রহস্য উদ্ঘাটনকারী তদন্ত কর্মকর্তাদের আমরা বিভিন্ন জেলায় পাঠাই। তাঁরা সেখানে গিয়ে মামলা নিয়ে ব্রিফ করেন। অন্য কর্মকর্তারা তখন এক পথে না গিয়ে অন্য পথে যাওয়া হলো কেন সেই প্রশ্ন তোলেন। সফল তদন্ত কর্মকর্তা তার ব্যাখ্যা দেন। কোনো কেসে ভুল থাকলে সেটাও উঠে আসে। এর মাধ্যমে কৌশল যেমন বের হয়, তেমনি প্রশ্ন বের হয়।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বড় অপরাধ ঘটলে ক্রাইম সিনে গিয়ে ছায়াতদন্ত করে তথ্য নিয়ে রাখে পিবিআই। যখন তদন্তভার পায় তখন সেই ফাইল খুলে নিজেদের তথ্যগুলো কাজে লাগায়। আর তদন্তভার পেলে পিবিআই অপরাধী শনাক্তের আগে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ও তার উত্তর যাচাই করে। এতে বাদী এমনকি আসামির তথ্যও সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাচাই করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘ডিএনএ, ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় আমরা সিআইডির সহায়তা নিই। আমাদের ফেস আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমে অপরাধীর ছবি বের করতে সফটওয়্যার আছে। এটিকে নিখুঁত করতে আমরা ৪০ জন আর্টিস্ট চাইছি।’

বাবুল আক্তারের মতো মামলার বাদীই আসামি হওয়ার ব্যাপারে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘এমন দুই ডজনেরও বেশি কেস আমরা পেয়েছি। এক জায়গায় গিয়ে রহস্যের কেন্দ্রে বাদীই চলে আসে। অপরাধ আড়াল করতে হত্যাকারীও বাদী হয়। মৌলভীবাজারে দাদি, চাচা মিলে ছয় বছরের এক শিশুকে মেরে ফেলার ঘটনাও বের করেছি।’ পুলিশের সদস্যদের অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তিন ধরনের মামলা আসে। কোনোটি পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ, কোনোটি দায়িত্ব পালনের বাইরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অপরাধ এবং অপরটি একান্ত ব্যক্তিগত বা পেশার বাইরে অপরাধ। প্রায় অর্ধশত ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ হয়েছে।’

মামলা তদন্তকালে রাজনৈতিক চাপ থাকে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পরিচয় সংস্কৃতির চাপ বা তদবির আসে। আমরা বিষয়গুলো আমলে নিই না। মামলা পাওয়ার পর রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে এই চাপটিই আমাদের কাছে বড়।’

এদিকে রহস্যঘেরা হত্যাকাণ্ড বা কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনার অনেক দিন পরও তদন্তে রহস্য উদ্ঘাটনের নজির স্থাপন করে চলেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রহস্য উদ্ঘাটনের এসব মামলাকে কেস স্টাডি হিসেবে গ্রহণ করছে পুলিশের এই তদন্ত সংস্থাটি। এরপর সফল তদন্ত কর্মকর্তাদের সেই কেস স্টাডি নিয়ে বিভিন্ন জেলার তদন্তকারীদের কাছে পাঠিয়ে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এতে কোনো প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল এবং কিভাবে কোন পথে তার সমাধান হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। এভাবেই অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে বেশি প্রশ্ন তৈরি এবং তার সমাধানের প্রশিক্ষণ চলছে।

পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা মনে করেন, যত বেশি প্রশ্ন তৈরি হবে তত বেশি উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেই উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তদন্তের রহস্য। এই কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। পিবিআই ল্যাবরেটরিতে বিশেষ ডিভাইস ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় শনাক্তের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে সংযুক্ত মেশিনও আছে। অপরাধীর স্কেচ বের করতে সফটওয়্যারের পর আঁকার নিজস্ব শিল্পীও যুক্ত হতে যাচ্ছে এই ইউনিটে। ৪০ জন ‘ক্রিমিনাল স্কেচ আর্টিস্ট’ নিয়োগের প্রস্তাবনা এখন বিবেচনাধীন। প্রস্তাবনা অনুমোদন হলে গতি আরো বাড়বে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১