আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১
বাংলাদেশে যারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন তাদের বেশিরভাগই কখনোই চিকিৎসা নিতে যান না, এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা। রাজধানী ঢাকায় একটি মানসিক হাসপাতালে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সাম্প্রতিক মৃত্যুর পর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে। এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সংকটময় বিষয়ের কথা বিবেচনায় রেখে দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল সোমবার বিকেলে স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ কার্যক্রমের সূচনা ও অবহিতকরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান। এদিকে মানুষ চিকিৎসা নিতে যায় না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হেয় হওয়ার ভয়, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অসচেতনতার কারণে বিশাল পরিমাণ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার বাইরে রয়েছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিন ধরনের কারণে মানুষ মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে যায় না। এর মধ্যে প্রথম কারণ হিসেবে সমাজের প্রচলিত স্টিগমাকে দায়ী করেন তিনি। মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজে এক ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, মানুষ এটাকে প্রকাশ করতে চায় না, লুকিয়ে রাখতে চায়। মানুষ মনে করে, মানসিক সমস্যা রয়েছে এটা প্রকাশিত হলে তারা সমাজের চোখে হেয় হয়ে যাবেন। এ নিয়ে এক ধরনের স্টিগমা তাদের মধ্যে কাজ করে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। মেডিকেল কলেজ কিংবা টারশিয়ারি পর্যায় ছাড়া আর কোথাও এই সেবা পাওয়া যায় না। বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র দুটি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য এ মুহূর্তে ২৭০ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন, যেটা অপ্রতুল। এক বছরে সাত থেকে ১০ জনের বেশি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রস্তুত হচ্ছে না বলেও জানানো হয়। যার কারণে অনেকেই এই সেবা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তৃতীয় কারণ হিসেবে অধ্যাপক আহমেদ মানুষের সাধারণ অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় মানুষ বোঝেই না তার আচরণগত সমস্যাটি মানসিক কারণে হয়েছে। বিপুল পরিমাণ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে এবং তারা একপর্যায়ে সমাজের বোঝায় পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়নে আরো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক হিসাব বলছে, সবশেষ ২০১৮ সালে তাদের যে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষই কোনো ধরনের সেবা বা পরামর্শ নেন না। বাকি মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ মূল ধারার চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর সেখানে শুধু মানসিক রোগের চিকিৎসক নন বরং অন্যান্য চিকিৎসকও রয়েছেন। যারা চিকিৎসা নিতে যান তারাও সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রথমদিকে নয় বরং একেবারে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কাছের মানুষরাও বুঝতে পারেননি বর্তমানে এক সন্তানের মা নাসরুন্নাহারের সমস্যা। বরাবরই প্রচণ্ড আত্মনির্ভরশীল আর চাপা স্বভাবের মানুষ। তবে হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে বসেন তিনি। নাসরুন্নাহার বলেন, এই ঘটনার আগে তার কাছের মানুষজনও বুঝতে পারেননি তিনি বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। কাছের মানুষ, এমনকি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডরাও জানত না। জানালার কাচ ভেঙে সেটি দিয়ে হাতের রগ কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, যেদিন সুইসাইড অ্যাটেম্পট করি তার আগের দিনও আমি কাজিনদের সাথে ট্যুর দিয়ে আসি। নাসরুন্নাহার বলেন, একেবারে শেষ স্তরে পৌঁছানোর পর যখন তিনি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন তখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমাকে দুদিন পাহারা দিয়ে রাখে যাতে আমি মরতে না পারি। একেবারে লাস্ট স্টেজে গিয়ে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছয়-সাত বছর আগে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার পর পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস নামে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন উন্নয়নকর্মী নাদিয়া সারোয়াত। তিনি জানান, দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার ১৪-১৫ দিনের মাথায় তার যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছিল সেটি হচ্ছে, নিজের সন্তানকেই চিনতে পারতেন না তিনি। খুঁজে বেড়াতেন তার প্রথম সন্তানকে। নাদিয়া সারোয়াতের সাথে যখন কথা হচ্ছিল তিনি জানান, অসুস্থ থাকার সময়টার অনেক বিষয়ই তিনি এখনো মনে করতে পারেন না। মানসিক সমস্যার জন্য ১০ দিন একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, সেসময় হাসপাতালের নার্সের হাতে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছিল তাকে। আমার ঘুম আসত না। পুরো হাসপাতাল ঘুরে বেড়াতাম। আর আমার বাচ্চাটাকে খুঁজতাম। নাদিয়া সারোয়াত বলেন, বাংলাদেশে মানসিক রোগীদের ভালোভাবে দেখা হয় না। বিভিন্নভাবে তাদের হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। হাসপাতালকর্মী বা যারা এর চিকিৎসার সাথে জড়িত তারাও মানসিক রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। আমাদের দেশে তো মানসিক রোগী দেখলে পাগল বলে একটা বাচ্চাও ঢিল ছুড়ে মারে। তাদের অপদস্থ করার এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে। এসব মানসিক সমস্যার কথা বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, জেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসার সংকট নিরসনে জেলায় জেলায় মেন্টাল হেলথ কর্নার বা সাইকিয়াট্রিক সেন্টার তৈরি করা হবে। দেশে দক্ষ জনসম্পদের সংকট রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিটি জেলায় সাইকিয়াট্রিক সেন্টার তৈরি করলাম, তখন দেখা যাবে দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো পড়ে থাকছে। দেশে দক্ষ চিকিৎসক এবং দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে, তাই আপনাদের অনুরোধ করব, সেন্টারগুলো যথাযথভাবে পরিচালনা যাতে হয়; সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’ জাহিদ মালেক বলেন, ‘আত্মহত্যা বা বিবাহবিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হারের পেছনে মানসিক সমস্যা প্রধানত দায়ী। ব্যক্তির বিষণ্নতার প্রভাব পড়ছে জীবনে, পরিবারে। তছনছ হচ্ছে সংসার। বিবাহবিচ্ছেদ, আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার আগে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম। তাদের অনুষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। আমরাও এ বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি। স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ কার্যক্রমের আওতায় বিশ্বের ১২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৬ নম্বরে। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ধন্যবাদ।’ করোনার টিকার বুস্টার ডোজ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ষাটোর্ধ্বদের ও ফ্রন্টলাইনারদের বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হবে।’ এ সময় ওমিক্রন মোকাবিলায় হাসপাতাল উন্নত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভাগের মহাপরিচালক এনায়েতুল্লাহ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সচিব আলী নূর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন ।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১