বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৫ জুন ২০২২

মুখ লুকিয়ে আর কতদিন?


শাহিনা নদী

পিরিয়ড কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয় যে, এটা নিয়ে মুখ লুকিয়ে কথা বলতে হবে। দেশ এখন অনেক এগিয়ে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সাথে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবু সমাজের কোনো এক অন্ধকার কোণে পিরিয়ড বিষয়টি আজও লুকিয়ে। কেউ এই বিষয়টি নিয়ে মুখ না খোলার কারণেই এই জড়তা-সংকোচবোধ। অথচ এটি প্রত্যেক নারীর জন্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যা আমাকে, আপনাকে এই পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের ফলে একটা সময় পর মেয়েদের জরায়ু ইনফেকশন, জরায়ু টিউমার, জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগতে হয় এবং প্রতিবছর অনেক নারী মৃত্যুবরণ করে। তাই পিরিয়ডকালীন নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যে কোনো পরিবারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পিরিয়ড নিয়ে সকল কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে নারীদের মুক্ত করতে পিরিয়ডের এই সময়টায় নারীদের নিরাপদে রাখতে হবে। পাশাপাশি স্যানিটারি ন্যাপকিন যাতে সহজমূল্যে পাওয়া যায় সেদিকে সরকারেরও উচিত সুদৃষ্টি দেওয়া। সমাজে খুব কম সংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। নাদিয়া সুলতানা তেমনই একজন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিলো অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। লকডাউনে শুরুতে তিনি লক্ষ্মীপুরে উদ্দেশে লঞ্চে ওঠার পর দেখেন একজন মহিলাকে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি পিরিয়ডের সময় কী ব্যবহার করো? মেয়েটি একটু সংকোচেই বলছিলো কাপড়। মহিলাটি মেয়ের মা-কে বলেন মেয়েকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দেন না কেন? উত্তরে মেয়েটির মা বলেন, ওগুলোর তো অনেক দাম। এই ঘটনাটি ভীষণভাবে নাদিয়াকে আঘাত করেছিল। এরপর পিরিয়ড বিষয়টি নিয়ে বিশদ খোঁজ নেন নাদিয়া। সেই সাথে উদ্যোগ নেন মেয়েদের পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবেন। এরপর দেড় বছর কেটে যায়। এই দেড় বছরে তিনি টাকা জমান এবং একটা টিম গঠন করেন। এবং সংস্থাটির নাম দেন ন্যাপ্রি এফ.থ্রি। ৯ মে ২০২১ আন্তর্জাতিক মা দিবসে, মা-কে সাথে নিয়ে তিনি কার্যক্রম শুরু করেন। তার টিমে পাঁচজন ছিলো। একদম শুরুর দিকে তিনি ও তার আম্মু মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ও কাউন্সেলিং করতেন। এরপর কাজের ছবিগুলো তিনি ফেসবুকে পোস্ট করতে শুরু করেন। তখন অনেক ছেলে-মেয়ে স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। এভাবেই বর্তমানে তার সংগঠনে ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে। লক্ষ্মীপুরের নন্দনপুর, দালাল বাজার, মজু চৌধুরীর ঘাট, পশ্চিম লক্ষ্মীপুর বেরিবাধ এলাকা, রায়পুরের একটা ফ্যাক্টরি, চাঁদপুরের লঞ্চঘাট এলাকা ও কয়লাঘাট এলাকা, ঢাকা এবং নেত্রকোনা এলাকায় নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে তারা কাজ করেছে। এই এলাকাগুলোর মেয়েদেরকে তারা প্রতিমাসের স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়ে থাকেন।

নাদিয়া সুলতানা স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর আইন বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। এর পাশাপাশি ন্যাপ্রি এফ.থ্রি এর ফাউন্ডার, তবে তিনি স্বেচ্ছাসেবী পরিচয়টা দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন NapreF3 এই নামটা এসেছে মূলত মেয়েদেরকে ‘পূর্বের ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য’। মেয়েদের এই ঘুম ভাঙাতেই বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, কাউন্সেলিং এবং নিরলস কাজ করে যাচ্ছে তিনি ও তার সংগঠন। F3 হচ্ছে তাদের টিমের স্লোগান। ত্রিপল এফ ডিফাইন করে- ‘Free From Fence’ যার মানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে আনা। যদিও NapreF3 এর মূল লক্ষ্য নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তবে এর বাইরে ও তারা দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে অসহায়দের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য রান্না করে খাবার খাওয়ানোর কাজও করেছেন।

এমন একটি অসাধারণ উদ্যোগ নেওয়ার শুরুতে নাদিয়ার পাশে তার পরিবার ছাড়া খুব কম সংখ্যক মানুষই ছিলেন। সমাজের এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য কম কথা শুনতে হয়নি। গ্রামের অনেক পুরুষরাই তাকে নিয়ে কটূক্তি করে বলতেন- ‘ইস মেয়েটার কি লজ্জা নেই? সামাজিক কাজ করার জন্য অন্য কোনো টপিক পায়নি নাকি?’ দয়ার একাগ্রতা এবং দৃঢ় মনোবল সেসব প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের ৪টি জেলায় ইতোমধ্যেই তিনি ও তার সংগঠন কাজ করেছে। চলতি মাসেই নাদিয়া একটি স্কুলে প্রতিষ্ঠা করেছে মেয়েদের জন্য ‘পিরিয়ড কর্নার’। নাদিয়া বলেন, ‘পিরিয়ড নারীর জন্য লজ্জার নয়; বরং গর্বের। আমাদের ইচ্ছে ভবিষ্যতে স্কুল কলেজগুলোতে মেয়েদের বাথরুমের পাশে ছোট করে পিরিয়ড কর্ণার করার। যেখান থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে ব্যবহার করবে। এবং পিরিয়ড নিয়ে একটি বই লেখার। যে বইটিতে পিরিয়ডের খুঁটিনাটি সব বিষয় সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করা থাকবে। এছাড়াও বাংলাদেশের ৬৫টি জেলায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা ছড়িয়ে থাকুক এটাই লক্ষ্য।’


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১