বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২০ জুলাই ২০২২

সম্মান ফেরত চান আইনপ্রণেতা


ঘটনা কারোরই বোঝার বাকি আছে কী? শিকারি বিড়ালের গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। ভাবভঙ্গিতেই অপরাধী ও কাজের লোক চেনা যায়। শাক দিয়ে মাছ ঢাকলাম, কিন্তু মাছের গন্ধ ঠিকই রয়ে গেল, পচা মাছ! অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে যদি চড়থাপ্পড়, লাথি, ঘুষি এবং হকিস্টিক দিয়ে পিটুনি না দেওয়া হয়, তাহলে তো অধ্যক্ষ সাহেবেরই হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহীর সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী কেন হাতজোড় করে সাংবাদিকদের কাছে তার সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানাবেন? অযথা একজন আইনপ্রণেতাকে সবাই এতদিন ভুল বুঝল! এই ধরনের একটি ঘটনাকে ভাইরাল রূপ দিতে গিয়ে কিছু বেকুব ‘সম্মানিত’ অধ্যক্ষ এবং ‘মহাসম্মানিত’ এমপি সাহেবের মানহানি ঘটিয়েছেন। তাদেরকে কেন আইনের আওতায় আনা হবে না?

এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর হাতে মার খাওয়ার অভিযোগ ওঠার পর গত ১৪ জুলাই সংসদ সদস্যকে পাশে নিয়েই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন অধ্যক্ষ সেলিম রেজা। সেখানে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ ফোরামের সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে নিজেরা নিজেরাই ধাক্কাধাক্কি করেছেন। সংসদ সদস্য তাদের নিবৃত্ত করেছেন। তাহলে সব অধ‍্যক্ষকে শাস্তির আওতায় আনা হোক। কারণ তারা নিজেরা আদব, ভদ্রতা না জানলে/শিখলে ছাত্রদের কী শেখাবেন? আর একজন আইনপ্রণেতার সামনে অভদ্রতা করা মানে ওনাকে অসম্মান করা— এই অপরাধেও অধ্যক্ষ ফোরামের শাস্তি হওয়া উচিত নয় কি?

গত ৭ জুলাই রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তার ‘থিম ওমর প্লাজা’র ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অধ্যক্ষ ফোরামের ৮ জন অধ্যক্ষ, একজন উপাধ্যক্ষ ও রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীর সামনে গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধর করেন। সবার সামনে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে এমপি ওমর ফারুক বেপরোয়াভাবে কিল, লাথি, ঘুষি এবং হকিস্টিক দিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করেন, যাতে অধ্যক্ষ সেলিম রেজার শরীরে বিভিন্ন স্থানে কালশিরা জমে ওঠার রিপোর্ট এসেছে। কিন্তু এই অভিযোগ অস্বীকার করতে সময় লাগেনি। ঘটনা মিডিয়ায় আসার পরের দিন এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ সেলিম রেজা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পরিবর্তে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা বলেছেন, অন্য অধ্যক্ষদের সাথে তার কিছু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে।

আমরা বলতে চাই, কে সত্যবাদী? এমপি না অধ্যক্ষ? অথবা এমপিও মিথ্যা বলছেন, অধ্যক্ষও মিথ্যা বলছেন? অধ্যক্ষের চাকরিটাই বড়, নীতি নয়? উচিত ছিল তার সঠিক অবস্থানে দৃঢ় থাকা। একজন অধ্যক্ষের চাকরি যাওয়া এতো সহজ নয়। বাবার উপরেও বাবা আছে; তার উপরেও বাবা আছে। প্রশাসনের লোকগুলো এখনো সবাই উন্মাদ হয়ে যায়নি। এখন তো তার সবই গেল। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর কাছে তার বিবেক, বুদ্ধি, সততা, আদর্শের মূল্য থাকল কী? শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান নিজেরাই ভূলুণ্ঠিত করছেন। এভাবে নৈতিক অবক্ষয় হলে শিক্ষকরা সব জায়গায়ই মার খাবেন। এটাই তাদের নিয়তি। শিক্ষক যে সত্য চেপে যাচ্ছেন পেশিশক্তির কাছে হার মেনে, এভাবে ছাত্ররাও হেরে যাবে। কারণ অনৈতিক শিক্ষক কীভাবে নৈতিক শিক্ষা দেবেন! আর যদি অধ্যক্ষ ফোরামের সদস্যরা সত্যিই মারামারি, ধাক্কাধাক্কি করে থাকেন, তাহলে তারা কী শিক্ষা দিবেন? অথবা সত্য লুকিয়ে মিথ্যাকে লালন করে আর যা-ই হোক কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি শফিকুর রহমান বলেছেন, অধ্যক্ষ সংসদ সদস্যের কাছে মার খেয়েছেন বলে তার কাছে স্বীকার করেছিলেন। পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার কারণে অধ্যক্ষ সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ভয়ে এখন ঘটনা অস্বীকার করছেন বলে তিনি মনে করেন।

পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। সাভারে দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু কর্তৃক তার শিক্ষককে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা। অন্যদিকে নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পড়ানো। সাভারে, নড়াইলে ও রাজশাহীতে শিক্ষকের ভাগ্যে যা ঘটেছে, এর প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজ অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। এটি ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ঠিক তেমনি এসব ঘটনারও যদি কোনো শাস্তি না হয়; তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হতে পারে। আগে তো শিক্ষকদের মধ্যে কোন দলাদলি ছিল না। ওনারা সুশিক্ষা দিয়ে গেছেন। এখন যেমন শিক্ষক, তেমন কমিটি, তেমন ছাত্র। লাল, সাদা, নীল, কত প্রকারের শিক্ষক রাজনীতি তৈরি হয়েছে, তা কি এমনিতেই? রাজনীতির বিপুল প্রসাদ বণ্টন হয়েছে এবং হচ্ছে বলে। এখন নীতি নির্ধারকদের দ্বারা প্রাথমিক/মাধ্যমিকে ছাত্রদের মগজে সঠিক পাঠদানের বদলে রাজনৈতিক শিক্ষা ও ক্ষমতাবান হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়ার নির্দেশনা থাকে। তখন যদি অভিভাবকরা অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গন রাজনীতিমুক্ত রাখার প্রতিবাদ করতেন, তাহলে হয়তো আজকে উৎপল বাবুর অকালে প্রাণ ঝরত না, অধ্যক্ষ সেলিম রেজার চড়থাপ্পড় ও হকিস্টিকের পিটুনি খেতে হতো না। সম্প্রতি শিক্ষকদের সাথে ঘটে যাওয়া এমন লাঞ্ছনা বঞ্চনা অনিয়ম কর্মকাণ্ড নিয়ে মোটেও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার যে এমন দুরবস্থা হতে চলেছে তা বিগত এক দশক ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও বেশকিছু শিক্ষকের ব্যক্তিগত কার্যক্রম দেখে সহজে ধারণা করা যাচ্ছিল। এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা আগামীর জন্য খুবই অশনিসংকেত। অতীতে একজন এমপি শিক্ষককে চড় মেরেছিলেন এবং এ জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। একজন শিক্ষককে সরকারি একজন বড়কর্তা বাধ্য করেছিলেন পা ধরে মাফ চাইতে। সে জন্যও কোনো শাস্তি হয়নি। অথচ একজন শিক্ষকই কিন্তু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, ব্যারিস্টার কিংবা আমলা তৈরি করেন। সেই শিক্ষকের মর্যাদা আমাদের সমাজে কোথায়? ছাত্র কর্তৃক প্রকাশ্যে শিক্ষক হত্যা ও একজন আইনপ্রণেতা কর্তৃক শিক্ষককে মারপিট! আমরা নিন্দার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জাতির সামনে বড়ই দুর্যোগ অপেক্ষমাণ।

অথচ অধ্যক্ষ সেলিম রেজার এমন বক্তব্যের পর সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চান, তার চোখের নিচে কালো দাগ কেন? তারা অধ্যক্ষের বাঁ হাতের কনুই দেখতে চান। সাংবাদিকদের কাছে তথ্য আছে, সংসদ সদস্যের মারধরে অধ্যক্ষের বাঁ হাতের কনুইয়ে ক্ষত হয়েছে। এ সময় অধ্যক্ষ তার হাত দুটি টেবিল থেকে নিচে নামিয়ে নেন। আহত না হলে কেন চিকিৎসা নিয়েছিলেন জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা বলেন, অ্যাক্সিডেন্টলি লেগেছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, অভিযুক্ত এমপি তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পেশিশক্তির বলে হয়তোবা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নির্যাতিত অধ্যক্ষকে দিয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন।

পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা চালুর পর গণতন্ত্রের বদলে তিনশ জমিদার সৃষ্টি করে দেশকে শাসন করা হচ্ছে। এই তিনশ জমিদার লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা জমিদারি চালান। আর কলোনিয়াল প্রশাসনের মতো লোকাল প্রশাসন চোখ বন্ধ করে প্রয়োজনে জমিদারদের পক্ষে কাজও করে। এই জমিদাররা দুর্নীতি, ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় ভোগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে। তাদের এ অসীম ভোগ দেখে জ্ঞানভিত্তিক সমাজটাও ভোগবাদী সমাজে পরিণত হচ্ছে। এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘থিম ওমর প্লাজা’র ব্যক্তিগত রাজসিক কার্যালয়ের মতো জমিদারি প্রথা উৎখাত করে, ভোগবাদ ছুড়ে ফেলে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্সিয়াল সরকারের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে।

একজন শিক্ষককে মারা তো দূরের কথা, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কোনো স্যারের চোখের দিকেও আমরা তাকাইনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা শিক্ষার হার বাড়িয়েছি, তবে সুশিক্ষিত করতে পারিনি। শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এখন দেখছি কিছু ছাত্ররা শিক্ষক মারার কারিগর। শিক্ষার্থী জিতুর স্ট্যাম্পের আঘাতে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকার মারা যান। সেখানে অভিযুক্ত ছেলেটির নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারেই, তার হীন অপকর্মের শাসন করাতে ক্ষুব্ধ হয়েই উৎপল কুমারকে বেধড়ক মারধর করে হত্যা করে। দশম শ্রেণির ছাত্র প্রকাশ্য দিবালোকে তারই এক শিক্ষককে ক্ষোভের বশে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দিব্যি বুক উঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করতে পেরেছে। পরে জানা যায়, ওই ছাত্র স্কুল কমিটিরই কারো সন্তান। দেশে কেউ একজন প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে উধাও হয়ে যেতে পারছে। কেউ তাকে একটা কথা বলারও সাহস পাচ্ছে না। আবার ৮/৯ জন অধ্যক্ষের সামনে একজন অধ্যক্ষকে চড়থাপ্পড়, লাঠিপেটা খেয়েও সংবাদ সম্মেলনে বলতে হয়, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে।

ঘরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমার সন্তান আদরে-শাসনে মানুষ হবে সেটাই আমরা চাই। শিক্ষা মানে শুধু সার্টিফিকেট নয়। প্রত্যেক শিক্ষককেই কঠোর হতে হবে, কিন্তু নিষ্ঠুর হওয়া নয়। শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষকদের হাতের লাঠি কেড়ে নিয়েছে এবং সেই লাঠি ছাত্রদের হাতে উঠে এসেছে। স্কুল থেকে শাসন নামের বিষয়টা যেদিন থেকে তুলে ফেলা হয়েছে, সেদিন থেকে গুন্ডা, অভদ্র এবং উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রনামধারী প্রজাতি তৈরি হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কড়া শাসন নেই, ফলস্বরূপ ছোট ছোট বাচ্চারা এখন বিড়ি টানে, কাউকে সম্মান করে না। আমাদের শুধু শিক্ষার হার দরকার। রাষ্ট্র বোধহয় শিক্ষিত মানুষ চায় না। আগে স্যারদের বেতের দিকে তাকাইলেই ভয় লাগতো। এখন তো যারা অভিভাবক আছেন বাচ্চাদের মারলেই প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দেন স্যারের বিরুদ্ধে। এসব কারণেই বাচ্চারা অতিরিক্ত বেয়াদব হচ্ছে। ছাত্রকে শাসন/পেটানো যাবে না দেশে এমন আইন আছে; কিন্তু শিক্ষক পেটানো যাবে না এমন তো কোনো আইন নেই! সমাজের অবক্ষয় তো আর দুই-একদিনেই হয়নি; অন্যায়গুলো প্রশ্রয় দিতে দিতে একসময় কঠিন অবস্থা হয়। বর্তমানে যা সবার সামনে প্রমাণিত।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ

abunoman1972@gmail.com


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১