বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২২

হাওরের সৌন্দর্য কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ


হাওরে ঘুরতে কে না ভালোবাসে। তবে সাঁতার না জানায় এ অঞ্চলে ঘুরতে এসে শোকের জলে ভাসতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। বর্ষায় হাওরে পানি আসার পর এমন মৃত্যুর সংবাদ প্রায়ই আসছে। চলতি বছর আগের সব মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আর এই বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রশাসনকেও। কর্মকর্তারা ভাবছেন, যে মৃত্যুগুলো হয়েছে, তার সিংহভাগই অসচেতনতার কারণে। বেশিরভাগ মানুষই মারা গেছে গোসল করতে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার পর।

এমনই এক শোকের খবরে পরিণত হয়েছেন মাদারীপুরের রাশেদুজ্জামান আকাশকে। ২৫ বছর বয়সী টগবগে এই যুবক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিলেন তিনি অবারিত জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগে। গত ২২ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরের কুর্শা এলাকায় গোসল করতে নেমে মৃত্যু হয় তার।

আকাশের সঙ্গে ছিলেন দুই বন্ধু, যাদের মধ্যে তুহিন মিয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় এবং হাসিব শিকদারের পটুয়াখালীতে। তারা সাঁতার জানতেন না। হাওরের স্রোতের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো দক্ষতাও ছিল না, ছিল না সেখানে পানির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণাও।

পানিতে নামার পরই ভেসে যেতে থাকেন তিনজন। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে। ডাঙায় মারা যান আকাশ আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় হাসিব ও তুহিনকে। পরে তারা প্রাণে বাঁচেন।

বর্ষায় হাওরে পানি আসার পর এমন মৃত্যুর সংবাদ প্রায়ই আসছে। চলতি বছর আগের সব মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আর এই বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রশাসনকেও। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভাবছেন, যে মৃত্যুগুলো হয়েছে, তার সিংহভাগই অসচেতনতার কারণে। বেশির ভাগ মানুষই মারা গেছে গোসল করতে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার পর।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর সঙ্গে যোগ হয়েছে গতির নেশা। হাওরের নতুন আকর্ষণ অলওয়েদার সড়কে এসে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন। সঙ্গে আছে মাছ ধরতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের কিশোরগঞ্জ কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবুজর গিফারী জানান, তাদের তথ্য মতে চলতি বর্ষায় এখন পর্যন্ত ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন এবং নিকলী হাওরে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

তাদের পরিসংখ্যানের বাইরে আরও মৃত্যু থাকতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় হাওরে ঘুরতে গিয়ে কোনো পর্যটক বা শিশু মারা গেলে তাদের মরদেহ সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলে সেই হিসাবটা আমাদের কাছে পৌঁছে না। আমাদের কাছে কেবল নিখোঁজের সংবাদগুলো আসে, যেগুলো উদ্ধার প্রয়োজন।

গত ১৮ জুলাই মিঠামইন হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন পল্লী বিদ্যুতের মিঠামইন জোনাল অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হোসাইন হিমেল। পরদিন দুপুরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়কের ৪ নম্বর বক্স কালভার্টের নিচ থেকে তার মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।

৩৫ বছর বয়সী হোসাইন হিমেল ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে বিয়ে করেন। ছুটি শেষে স্ত্রীকে নিয়ে কর্মস্থলে ফেরেন। পরদিন অফিসের পিয়ন রফিককে সঙ্গে করে ঝাঁকি জাল নিয়ে বের হন হাওরে মাছ ধরবেন বলে। জাল ফেলার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন।

এর পাঁচ দিন আগে ১৩ জুলাই মিঠামইনে হাওরে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল নামাপাড়া এলাকার বাসিন্দা তানজীব সারোয়ার হিমেল। ২৬ বছর বয়সী এই যুবক ছাড়াও সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসানপুর সেতুর কাছে গোসল করতে নামেন তার চাচাতো ভাই মো. নাজমুল ও ফুপা মো. বকুল।

পানিতে নামার পর ভেসে যান হিমেল। পরদিন সকালে ফায়ার সার্ভিসের একটি ডুবুরিদল তার মরদেহ উদ্ধার করে।

১৫ জুন করিমগঞ্জ উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নের বালিখলা ফেরিঘাটের পাশে চং নোয়াগাঁও এলাকায় নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ হন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুল্লাহ হাবির। পরদিন ভোরে তার মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ।

তার আগের দিন ইটনায় হাওরে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ হন বাবা-ছেলেসহ তিনজন। পরদিন সকালে উপজেলার বড়িবাড়ী ইউনিয়নের এন সহিলা গ্রামের সামনে থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এই তিনজন হলেন করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাইদ ইউনিয়নের হালগড়া গ্রামের ৬০ বছরের সিরাজ উদ্দিন ও তার ছেলে ৩৫ বছরের ওয়াসিম এবং তাড়াইল উপজেলার দামিহা এলাকার ২৫ বছরের মাসুদ মিয়া।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আবুজাফর গিফারী বলেন, সাঁতার না জেনে অনেকেই পানিতে নেমে যান। আবার অনেকে হাওরে যাওয়ার পথে অথবা ফেরার পথে নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন।

তিনি বলেন, হাওরে বেড়াতে গিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরা থাকলে এবং স্রোতে গোসল করতে না নামলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসত।

ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রওশন আলী রুশো জানান, এই মৃত্যুর কারণ অজ্ঞতা, অসাবধানতা আর সাঁতার না জানা।

তিনি বলেন, পাহাড়ের নদীগুলোতে গিয়ে কেউ যদি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে, তাহলে সেখানে থাকা পাথরের মাঝে পা আটকে যেতে পারে। কক্সবাজারে গিয়ে জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে না জেনে পানিতে নামলেও মৃত্যু হতে পারে। তেমনি হাওরের স্বচ্ছ পানি দেখে সাঁতার না জেনে কেউ যদি ঝাঁপ দেয়, সে ক্ষেত্রে তার মৃত্যু হতে পারে।

 

এসব মৃত্যু ঠেকাতে এ ক্ষেত্রে হাওরের বিভিন্ন জায়গায় সতর্কাতামূলক সাইনবোর্ড টানানোর পাশাপাশি প্রশাসনের নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি হাওরে দ্রুতগামী জলযানসহ জরুরি সেবা চালুর পরামর্শও দিয়েছেন।

সাংবাদিক সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন বলেন, হাওরে পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেগুলোতে নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় হাওর এলাকায় পর্যটকদের ঘোরাঘুরি, হাওরের পানিতে নামা, সাঁতার কাটা সবকিছু নিজ উদ্যোগেই করতে হয়। দূর থেকে যারা হাওর ভ্রমণে আসেন, হাওরের পানি প্রবাহ, স্রোত, কোন জায়গায় পানির পরিমাণ কতটুকু, সেসব বিষয় তারা অবগত নয়। এমনকি সাঁতার জানা থাকলেও তীব্র স্রোতে তারা টিকতে পারেন না। ফলে ঘটছে প্রাণহানি।

পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি শরীফ আহম্মেদ সাদী এসব মৃত্যুকে দেখছেন প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবে। তিনি বলেন, ‘দেশের অন্যান্য পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের যেভাবে সচেতন করা হয় তার কোনো কিছুই কিশোরগঞ্জে নেই। হাওরের প্রবেশপথে বড় বড় বিলবোর্ডে ঝুঁকিগুলো উল্লেখ করা যেত, লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা যায়, আবার উদ্ধারকর্মী নিয়োগও জরুরি। এসব করতে পারলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক শামীম আলম বলেন, এই বিষয়গুলো তাদের চিন্তায় আছে। তিনি বলেন, হাওরের বিভিন্ন প্রবেশপথে প্রচার-প্রচারণাসহ বিপজ্জনক স্থানগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হাওর ভ্রমণের জন্য যে নৌকাগুলো ব্যবহূত হয়, সেগুলোতেও মোটিভেশনাল কার্যক্রম করা হবে, পর্যটকরা যাতে যত্রতত্র পানিতে না নামেন।বেপরোয়া গতিতে বাইক চালিয়ে অলওয়েদার সড়কে কয়েকটি মৃত্যুর পর হাওর ভ্রমণে বাইক না আনতে বালিখলা ফেরিঘাটে মাইকিং করেছে থানা পুলিশ। কিন্তু এই ঘাট এড়িয়ে অন্য পথে নৌকায় করে বাইক নিয়ে হাওরে যাচ্ছেন তরুণরা। জেলা প্রশাসক শামীম আলম জানান, অলওয়েদার সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

 

 

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১