বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২২

সিইসির সাম্প্রতিক বোল-চাল


প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সাম্প্রতিক কিছু কথাবার্তা জনমনে যুগপৎ চাঞ্চল্য ও সংশয় সৃষ্টি করেছে। তার বক্তব্যে এটা মনে হচ্ছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে আরোহণ করে তিনি মস্ত বিপাকে পড়ে গেছেন এবং এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়তে পারলেই যেন বেঁচে যান। সাংবিধানিক এ পদটিতে যিনি অধিষ্ঠিত হন, তাকে যে কথাবার্তা বলার সময় হিসাব মেনে চলতে হয়, কাজী হাবিবুল আউয়ালের বাতচিতে তার অনেকটাই অনুপস্থিত। এ বিষয়ে আলোচনা করার আগে তার সাম্প্রতিক কয়েকটি উক্তি তুলে ধরলে সম্মানিত পাঠকদের বিষয়টি অনুধাবনে সহায়ক হবে। প্রসঙ্গত বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যে ধারাবাহিক সংলাপ চলছে, তাতে দেয়া তার যেসব বক্তব্য-মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে অনুমান করা যায় যে, দেশের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি ঠিক খেই রাখতে পারছেন না। পাশাপাশি তার ওইসব বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে বিতর্কের। গত ১৭ জুলাই জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে সংলাপে তিনি বলেছেন, সব দল সহযোগিতা না করলে ইসি ব্যর্থ হয়ে যাবে। কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব? আমরা সাহায্য করব। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে।’

সিইসির এ বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে তীব্র নিন্দার ঝড় তুলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সংলাপে অংশ নেওয়া এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে বলেছেন, ‘কেউ একজন পিস্তল নিয়ে মাঠে নামলেই আমি শটগান নিয়ে মাঠে নামতে পারি না। কারণ, আইন আমাকে বাধা দেয়। ভোটকেন্দ্র দখল হলে প্রশাসনকে দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। প্রশাসনের নিরপেক্ষ আচরণের নিশ্চয়তা ইসিকে দিতে হবে।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক। এসব কথাবার্তা যত কম বলা যায় তত ভালো। আর একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের কথাবার্তা বলা হলে সেটা জনগণও ভালোভাবে নেয় না। যিনি বলেন তারও সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেছেন, সিইসির এমন মন্তব্য ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাসকে আরও উসকে দেবে। সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি এ মন্তব্য করতে পারেন না। এটা অনৈতিক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সিইসির বক্তব্যে বিস্ময় ও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এটা সহিংসতাকে উসকে দেবে। এমন আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান তিনি। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। নতুন কমিশনের দায়িত্ব ছিল আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা। তাদের এ ধরনের বক্তব্যে জনমনে আস্থাহীনতা আরও বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন। (সমকাল, ১৮ জুলাই, ২০২২)

সিইসির এই মন্তব্য যে কতটা বালখিল্য তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যার বা যাদের দায়িত্ব হলো ভোটের মাঠকে সন্ত্রাসমুক্ত ও নিরুপদ্রব রাখতে সচেষ্ট থাকা, তারা যদি আরেক পক্ষকে পেশিশক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করেন, তাহলে পরিণতি কী হতে পারে তা না বললেও কারো বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। খেলার মাঠে কোনো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ল্যাং মারলে বা কনুইয়ের গুঁতোয় ধরাশায়ী করে ফাউল করলে রেফারির দায়িত্ব ওই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। প্রয়োজনে হলুদকার্ড দেখিয়ে সতর্ক করা কিংবা লালকার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া। প্রতিপক্ষকেও ফাউল খেলার জন্য উৎসাহিত করা নয়। সন্দেহ হচ্ছে, নতুন এই সিইসি আদৌ তার পদের গুরুত্ব এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগত কি না। কেননা কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক বা প্রকৃতিস্থ মানুষ সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার মতো এমন কথা বলতে পারেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অবশ্য দুদিন পরেই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল অনুধাবন করেছেন যে, তিনি একটি ফাউল কথা বলে ফেলেছেন। তাই বলেছেন, হিউমার (রসিকতা) করে তিনি ওই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তার তো বোঝা উচিত সবকিছু নিয়ে হিউমার চলে না। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে বসে। এমন হিউমার যে ‘রিউমার’ (গুজব) ছড়িয়ে মহাসর্বনাশ ডেকে আনতে পারে সে খেয়াল তো রাখা উচিত।
গত ১৮ জুলাই চারটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসে সিইসি গণমাধ্যমসহ নানা মহলের সমালোচনায় তিনি হতাশ মন্তব্য করে বলেছেন, ‘আজকে যদি বিদায় হতে পারতাম, ভালো লাগত। রাজনীতি-নির্বাচন ব্যবস্থা অনেক কিছুই পচে গেছে। সিইসি জানিয়েছেন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা সমালোচনায় হতাশ হয়ে তিনি ইউটিউব দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। বলেছেন, যখনই আমার ছবি দেখি, বুঝতে পারি বাপ-দাদাসহ গালাগালি শুরু হবে। এজন্য দেখি না।’ সিইসির বিদায় হতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে তার অক্ষমতার কথাই স্পষ্ট হয়েছে। কাজ করলে যেমন প্রশংসা পাওয়া যায়, তেমনি ভুল কাজ করলে বা ভুল কথা বললে নিন্দা-সমালোচনাও কপালে জোটে। ‘কাঁথা মুড়ি দেলে যমে ছাড়ে না’ বলে যে প্রবাদটি আমাদের দেশে প্রচলিত, সিইসি হাবিবুল আউয়ালের তা স্মরণে রাখা দরকার। তিনি ইউটিউব-টিভি দেখা কিংবা সংবাদপত্র পাঠ বন্ধ করে দিলেও কি সমালোচনা থেকে রেহাই পাবেন? তার তো জানা উচিত ‘অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।’ যদি তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারেন, এর চেয়েও কঠোর সমালোচনা তাকে হজম করতে হবে। সমালোচনার ভয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে পিঠটান দেওয়া যে কাপুরুষতার লক্ষণ তা নিশ্চয়ই সিইসি জানেন এবং মানেন। তার ভাষায়— রাজনীতি-নির্বাচন ব্যবস্থা যদি পচে গিয়েই থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব সেগুলোকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। অস্বীকার করার জো নেই এ এক কঠিন দায়িত্ব। যদি তিনি সফল হতে পারেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বীরের মর্যাদা পাবেন। আর যদি পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে যেনতেনভাবে দায়িত্ব শেষ করতে চান, তাহলে তার নাম কে এম নূরুল হুদার পাশেই স্থান পাবে।

এদিকে গত ২৬ জুলাই সিইসি আগামী সাধারণ নির্বাচনের সময় অর্থ ও পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণে তাদর অক্ষমতা ব্যক্ত করে বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থা অপসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। পয়সা ঢালছে, মাস্তান ভাড়া করছে। আজকাল একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করতে খুব বেশি পয়সা লাগে না। অর্থশক্তি, পেশিশক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সবাইকে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। মাঠে আপনাদের থাকতে হবে। আমাদের তথ্য দিলে আমরা আপনাদের সাহায্য করব। নির্বাচন কমিশন ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই প্রতিশ্রুতির কিছু মূল্য থাকা উচিত। একেবারে যে আমরা ডিগবাজি খেয়ে যাব তা তো নয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিয়মের কথাও উল্লেখ করেন। (আজকের পত্রিকা, ২৭ জুলাই ২০২২)। ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি থেকে সিইসি বা তার কমিশন ডিগবাজি খাবেন না বলে উল্লেখ করলেও তার সে কথায় কতটা আস্থা রাখা যায় তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আর এ সংশয়ের জন্ম সিইসির কথাবার্তা থেকেই। একটি নির্বাচনকে ‘ভালো নির্বাচন’ হিসেবে পরিগণিত করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সর্বাগ্রে গণ্য। অংশগ্রহণকারী দলগুলোক নিয়মের মধ্যে রাখা, আইন মানতে সবাইকে বাধ্য করা, নির্বাচনী বিধি পালনে সবাইকে বাধ্য করা, ভোটের মাঠের শৃঙ্খলা রক্ষা, কালো টাকা ও পেশিশক্তির অপব্যবহার রোধ, এ সবকিছুই নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং তাদের অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন যদি এর একটিও পালনে ব্যর্থ হয় কিংবা শিথিলতা প্রদর্শন করে, তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।

দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং অনিয়ম অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির কথা বিশিষ্টজনেরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। কেউ কেউ এজন্য একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন। সে সংস্কার বা কাঙ্ক্ষিত সুস্থ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সাংবিধানিক ধারা মোতাবেক আমাদের নির্বাচন কমিশন প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী। সে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, এটাই জনগণ আশা করে। তা না করে তারাও যদি সুশীল সমাজের মতো এজন্য ‘সামাজিক আন্দোলন’ গড়ে তোলার কথা বলে দায়িত্ব শেষ করতে চান, তাহলে বলতেই হয় এটা বাংলাদেশের মানুুষের দুর্ভাগ্য। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও অবাধ করতে যাদের পালন করার কথা অগ্রণী ভূমিকা, তারা পালন করতে চাচ্ছে সাহায্যকারীর ভূমিকা।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাম্প্রতিক এসব বোল-চাল পর্যালোচনা করলে এটা অনুমিত হয় যে, তিনি কোনোরকমে তার দায়িত্বকাল পার করতে পারলেই যেন বেঁচে যান। যদি তা-ই না হবে, তাহলে ‘আজকে বিদায় হতে পারলে ভালো লাগত’ খেদোক্তি করতেন না। তিনি হয়তো অনুমান করতে পেরেছেন গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ধারার সৃষ্টি হয়েছে, সে ধারা থেকে বেরিয়ে ভালো কিছু তিনি দিতে পারবেন না। ২৮ জুলাই সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে মেরুদণ্ড দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। জবাবে সিইসি বলেছেন, মেরুদণ্ড বাঁকা নয়, নতজানু হয়ে নয়, মেরুদণ্ড শক্ত রেখেই তারা কাজ করাতে চান। তাতে কতটুকু সফল হবেন সেটা আল্লাহ জানেন। সিইসির মেরুদণ্ড শক্ত রেখে দায়িত্ব পালনের এই প্রত্যয়কে সাধুবাদ না জানানোর কিছু নেই। তবে সংশয় অন্য জায়গায়। দুদিনেই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যিনি আজই দায়িত্ব থেকে ছেড়ে দিতে পারলে বেঁচে যান বলে মনের খেদ প্রকাশ করেন, তিনি মেরুদণ্ড কতটা সোজা এবং শক্ত রাখতে সমর্থ হবেন, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। কথায় আছে, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়’।

নির্বাচন প্রশ্নে আমরা ঘরপোড়া গরু। অতীতে এমনসব ঘটনা দেখেছি যে, কারো মুখের কথায় আর ভরসা করতে পারছি না। অতীতে কোনো কোনো নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ড সোজা-শক্ত রাখা তো দূরের কথা, মেরুদণ্ডহীনতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও যদি তাদেরই অনুগামী হন, তাহলে এ জাতির কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কীইবা করার থাকবে!

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১