বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

মুসলিমদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে করণীয় (১)


মুহাম্মদ ইয়াসিন ত্বোহা

মুসলিম উম্মাহ আজ দিশেহারা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে লুণ্ঠিত মানবতার নাম মুসলিমসমাজ। আমাদের চিন্তা করা দরকার যেই মুসলিম উম্মাহ সর্বদা নেতৃত্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল, আজ তাদের এই অধঃপতন কেন? কেনইবা মাত্র ৫.২ মিলিয়ন ইহুদি প্রায় দেড়শো কোটি মুসলমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বায়তুল মুকাদ্দাসে আধিপত্য বিস্তার করছে? কেনইবা প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের ভ্রুক্ষেপ করছে না? কেনইবা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা সত্ত্বেও আমাদের রক্ত জেগে উঠে না? নিশ্চয়ই মুসলিম উম্মাহ গুরুতর পাপে জড়িয়ে আছে। যা এমন অধঃপতনের পথকে সুগম করছে।

 

মুসলিম উম্মাহ কখনো কাফেরদের শক্তির দ্বারা পরাজিত হয় না; বরং নিজেদের দুর্বলতার কারণেই পরাজিত হয়। যার স্পষ্ট উদাহরণ বদর ও উহুদ যুদ্ধ। বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের দৃঢ়তার বলয়ে অনায়াসেই বিজয় লাভ হয়। কিন্তু উহুদ প্রান্তরে সামান্য আনুগত্যহীনতার কারণে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। উম্মাহর প্রতিটি মানুষের অন্তরে আজ ব্যাধির আবাস। দুনিয়ার লোভ ও মৃত্যুকে অপছন্দ করাই হলো সেই গুরুতর ব্যাধি। সাহাবায়ে কেরাম জান্নাতলাভের আশায় মৃত্যুকে ভালোবাসতেন। কিন্তু আমরা দুনিয়ার লোভে মৃত্যুকে অপছন্দ করছি। উম্মাহর দুর্যোগটা মূলত মুসলমানদের অন্তরে দুনিয়ার ভালোবাসা বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা। মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যাপারে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, খাদ্য গ্রহণকারীদের যেমনিভাবে খাবারপাত্রের চতুর্দিকে ডেকে আনা হয়, তেমনিভাবে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে ডেকে আনবে। এক ব্যক্তি বললো, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা বরং সেদিন প্রচুর সংখ্যক হবে। কিন্তু তোমরা হবে বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক দূর করে  দেবেন এবং তোমাদের অন্তরে ‘আল-ওয়াহন’ ঢেলে দেবেন। সাহাবিরা বললেন, হে রাসুলুল্লাহ! ‘আল-ওয়াহন’ কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলো দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’ (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-৪২৯৭)

 

আজ এই দুনিয়ার লোভে মুসলমানগণ নিজেদের জাত-পরিচয় ভুলে গেছে। সামান্য স্বার্থের জন্য মুসলিমরা দীনের ক্ষেত্রে ত্রুটি করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ক্ষমতা ও অর্থ লোভে কাফেরদের সাথে হাত মিলাচ্ছে। এমন কী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিশাপপ্রাপ্ত ইহুদিদের সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলছে। মুসলিম আজ তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে গেছে। আমরা ভুলে গেছি সাহাবায়ে কেরামগণের শহিদি চেতনা। ভুলে গেছি তারিকের পুত্র জিয়াদ কর্তৃক আন্দালুসিয়া তথা বর্তমান স্পেন জয়ের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ভুলে গেছি সুলতান ইমামুদ্দিন জিনকি ও তার পুত্র নুরুদ্দিন মাহমুদ জিনকির ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস। ভুলে গেছি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক সমগ্র খ্রিস্টান জাতিকে পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের ইতিহাস। ভুলে গেছি লেবাননের বীর শহীদ ওমর মুখতারের সেই অমীয় বক্তব্য ‘আমরা কলোনী মুক্ত করবো নয়তো শহিদ হবো’। সেদিন ইতালির মুসোলোনী কর্তৃক শত লোভ-লালসার প্রস্তাব ওমর মুখতারকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ওমর মুখতারের বক্তব্য ছিল, আমার শাহাদৎ উম্মাহর জন্য শিক্ষা হবে যে, মুসলিম ফাঁসির কাষ্ঠ বরণ করবে তবুও বাতিলের সাথে আপস করবে না। কিন্তু আফসোস, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ সামান্য ক্ষমতা, আর্থিক সহায়তা ও পণ্য-দ্রব্যের লোভে কাফেরদের নিকট নিজেদের আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দিচ্ছে।

 

মুসলমানদের নিকট আজ আখেরাতের মূল্য নেই। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘বলুন, দুনিয়ার সুখ সামান্য। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করবে তার জন্য আখিরাত উত্তম।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৭৭) মুসলমান আজ এই আয়াত অমান্য করায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। আর ধ্বংসের পরেই হয় পরিবর্তন। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন।’ (সুরা মোহাম্মদ, আয়াত-৩৮) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া সামান্য মাত্র। এব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কসম! আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হচ্ছে, ‘যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রের জলে এই আঙ্গুল (তর্জনী) রাখলো। অতঃপর তোমাদের কেউ যেন দেখে তার আঙ্গুল কতটুকু পানি উঠিয়ে আনতে পেরেছে। আজ দুনিয়া ও আখেরাতের এই পরিধির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা। আমাদের পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। দূর করতে হবে আমাদের সব ব্যাধি। এখানে ব্যাধি থেকে পরিশুদ্ধতার কিছু উপায় তুলে ধরা হলো।

 

১. দুনিয়ার লালসা থেকে মুক্ত হওয়া : দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত অন্তর লুণ্ঠিত ভূমি মুক্ত করতে পারে না। দুনিয়ামুখী মানুষ কেবল নিজের জন্যই বেঁচে থাকে। কেবলই খাদ্য, পানীয়, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিনোদন ও বিলাসিতায় মত্ত থাকে। এই অবস্থায় বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদেরকে বিজয় লাভের জন্য হজরত হানজালা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর জীবনী অনুসরণ করতে হবে। ওহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শহিদ হয়েছেন। একেক জনের লাশ মোবারক এনে এক জায়গায় রাখা হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুনে দেখলেন ৬৮ টি লাশ মোবারক। ২ টি নেই, একজন তাঁর চাচা হামজা (রা.) আরেকজন হানজালা (রা.)। অস্থির হয়ে পড়েছেন নবীজি। সকল সাহাবিদেরকে পাঠালেন লাশ মোবারক খোঁজার জন্য। হঠাৎ বোরখা পড়া এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন নবীজির সামনে। মহিলা আরজ করলেন; ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজ আপনি একটা বিয়ে পড়িয়েছেন? রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; হা আমি তো হানজালা (রা.) বিয়ে পড়িয়েছি। যার বিয়ের খুশিতে আমি খুরমা খেজুর ছিটিয়ে ছিলাম। মহিলা বললেন; ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাতের মেহেদী এখনও শুকায় নি। কাল বিকেলে বিয়ে হয়েছে আর রাতে উহুদের যুদ্ধের জন্য বের হয়ে গেছেন হানজালা (রা.)। বাসর রাতে তার সাথে আমার ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেছেন ‘যদি দেখা হয় তাহলে দেখা হবে দুনিয়ায়, আর যদি শহিদ হয়ে যাই তাহলে দেখা হবে জান্নাতে’। আল্লাহু আকবার। মহিলা বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাওয়ার আগে লজ্জায় আমি তাঁকে বলতেও পারিনি যে আপনার জন্য গোসল ফরজ। ভালোবাসার  কান্ডারি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁদতে লাগলেন। একজন সাহাবি দৌড়ে এসে বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হানজালা (রা.) কে পাওয়া গেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে যাওয়ার সময় দুই হাত দিয়ে ভিড় ঠেলে (যদিও পুরা জায়গাই ফাঁকা ছিল, সাহাবারা প্রশ্ন করলে নবীজি বলেন যে, হানজালা (রা.) কে গোসল দিতে আকাশ থেকে ফেরেশতারা এসেছেন। লাশ মোবারকের কাছে গিয়ে দেখলেন লাশ মোবারকের মাথায় পানি। নবীজি মাথা হাত বুলিয়ে দিলেন। জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হানজালার (রা.) কোরবানিতে আল্লাহ এতটাই খুশি হয়েছেন যে তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করলেন জমজমের পানি দিয়ে গোসল করাতে এবং তাঁর শরীরে যে সুগন্ধ দেখছেন এটি বিশেষ খুসবু মিশক আম্বর আতর যা কাফনের কাপড়ে ঢোকানো হয়েছে।

 

হজরত হানজালার মতো দুনিয়ার বোঝা থেকে ভারমুক্ত হয়ে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসায় নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই কেবল উম্মাহর সোনালী দিন ফিরে আসবে।

 

২. উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধকরণ : মুসলমানদের দলগত শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে যা প্রয়োজন তা হলো আল্লাহর ভয় এবং পারস্পরিক ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামের বিকল্প নাই। মুসলিম উম্মাহ যদি সম্মিলিত ভাবে সারা বিশ্বে একযোগে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ভূখণ্ডকে মুখরিত করতে পারতো তাহলে এই বিশ্ব ভুবনের সকল জালিমের হাত থেকে তাদের ঝাণ্ডা পড়ে নিঃস্ব হয়ে যেতো। মুসলমান আজ নিজেরাই নিজেদের শত্রু। নিজেরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত। এক দল যখন অপর দলকে কাফের বাতিল ফতুয়া দিতে ব্যস্ত তখন কাফের সমপ্রদায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। মুসলমানদের অনৈক্যের ফলে মুসলিম নিজেদের ভূখণ্ড হারাচ্ছে।

 

৩. সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ করা : মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা আল ইমরানের ১৮৫ আয়াতে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে’। মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু কী আছে এই পৃথিবীতে? জীবনের মোহে পড়ে আমরা বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যুর মতো অবধারিত সত্য ভুলে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ি। মৃত্যুকে স্মরণ মানুষকে পাপকর্ম থেকে বাঁচায়। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে সহায়তা করে। মনকে নরম করে। ইবাদতে আসে একনিষ্ঠতা। এমন কেউ কি আছে, যে মৃত্যুকে ভয় পায় না? মৃত্যুর স্মরণে মনটা কেঁপে ওঠে না? মৃত্যুকে স্মরণের কথা রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক হাদিসে বলা হয়েছে। সাহাবিরা মৃত্যুকে স্মরণে হাউমাউ করে কাঁদতেন। আল্লাহপ্রেমে মশগুল মানুষমাত্রই মৃত্যুর স্মরণে ভীত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জীবনের স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো (তিরমিযি, হাদিস নং-২৩০৭)। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কথা স্মরণ করা দরকার এ জন্য যে, প্রথমত এটা পাপকর্ম থেকে বিরত রাখবে। দ্বিতীয়ত, বান্দা যখনই মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে, তখন পরকালের পাথেয় সংগ্রহে তৎপর হবে। হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, দুনিয়াতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি কারা? তিনি জবাব দিলেন, যারা মৃত্যুর কথা অধিক পরিমাণে স্মরণ করে এবং তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দুনিয়া-আখেরাতে তারাই সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরিহিত হবে। (মুজামুল কাবির-১৩৫৩৬) [আগামীকাল পড়ুন ২য় ও শেষ পর্ব)

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১