রাশেদুল আলম
সময়টা ডিসেম্বর ২০১৭। আমি তখন নবম শ্রেণিতে। কয়েকদিন হলো বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বেশ কয়েকমাস আগের পরিকল্পনা ছিল পাহাড় দেখতে যাওয়ার। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার উদ্দেশে একটা ব্যবহূত ডিজিটাল ক্যামেরাও কেনা হয়ে গেছে । এবার শুধু পাহাড়ের উদ্দেশে বেরোনোর পালা।
বাসা থেকে কোনোমতে অনুমতি নিয়ে আমি আর ওমর বেরিয়ে পড়লাম বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে। দুইজন কিশোর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশে, সাথে ছিল ২০০০ টাকা, একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আর একটা নোকিয়া বাটন মোবাইল। স্টেশনে গিয়ে মেইল ট্রেনের অপেক্ষা।
আগে থেকেই জানা ছিল মেইলে প্রচুর ভিড় হয় আর আমরা এর জন্য প্রস্তুতও ছিলাম। কোনোমতে ট্রেনে উঠলাম। এরপর এক বিভীষিকাময় রাত। একের পর এক স্টেশন পার হচ্ছে, লোক উঠছে আর নামছে ভিড় কমার কোনো লক্ষণ নেই। যাই হোক সারা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গেলাম সীতাকুণ্ডে। তবে এই একরাত ছিল যেমন বিভীষিকাময় তেমনি খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল অল্প আয়ের মানুষের জীবন চিত্র। যাই হোক স্টেশনে নেমে অনুভূতি ছিল অন্যরকম । অচেনা এক জায়গা, শীতের সকাল, চারদিকে ঘন কুয়াশা, এর মধ্যে আমি খুঁজতে ছিলাম পাহাড় কোথায়? সে কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে আমায় দেখছিল আর হাসছিল হয়তো।
স্টেশনে এসেই চলে গেলাম পাশের খাবারের দোকানে। গরম পরোটা আর ভাজি দিয়ে সেরে নিলাম সকালের খাবার। খাওয়া শেষে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম পাহাড়ের পথটা কোন দিকে। সে রাস্তা বলে দিলো পাশাপাশি পরামর্শ দিলো,‘আরেকটু পরে যাও, এখন অনেক কুয়াশা পাহাড়ে লোকজন নেই প্রায়’। স্টেশনেই কাটালাম কিছু সময়। আর কাউকে পাওয়া যায় কিনা দেখলাম। নাহ আর কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেলাম না দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম চন্দ্রনাথ অভিযানে।
স্টেশন থেকে একটু সামনে গিয়ে বা দিকের এক রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। একটু পর পাকা রাস্তায় উঠে রিকশা নিয়ে চলে গেলাম চন্দ্রনাথে উঠার প্রবেশদ্বারে।
পথিমধ্যে বেশ কিছু সুন্দর মন্দির আর ছোট টিলাও দেখেছিলাম, যা দেখে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়ছিল।
পাহাড়ের পাদদেশে থেকে লাঠি কিনে শুরু হলো প্রথম পাহাড় অভিযান । দেখতে দেখতে প্রায় ২ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। এটাই ছিল জীবনে প্রথম পাহাড়ে ওঠা, ওপর থেকে দূরের নিচের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরবাড়ি দেখা, দিগন্তজুড়ে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা অনুভব করা। একটু পর পর কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল চারপাশের পাহাড় শ্রেণিগুলো। সুদূর গাজীপুর থেকে ১২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এসে প্রকৃতির আতিথিয়েতায় যেন ১৬ আনা কষ্টই সুদে আসলে উসুল। এর মাঝে এক সময় হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়, ছবি তোলার সময় হুট করে ছোট্ট ক্যামেরাটা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য ভাবলাম এই ছিল কপালে, তবে এবারের মতো কপাল ভালো ছিল ব্যাটারি খুলে আবার অন করার পর ক্যামেরা কাজ করলো। এরপর মন ভরে তুললাম পাহাড়ের ছবি। তবে তখনো মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিল পাহাড় থেকে নেমে কীভাবে অন্যান্য জায়গাগুলোতে যাবো! তখন তো আর সাথে স্মার্টফোন আর গুগল ম্যাপ ছিল না । যাই হোক আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন।
পাহাড়ের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে ছবি তোলা শেষে যখন নামতে শুরু করবো তখনই দেখা হলো তিন ভাইয়ার সাথে তারা এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। ভাবলাম আরেকটু থাকি তারপর একসাথেই নামি। আর এই একটা সিদ্ধান্তই আমাদের ভ্রমণটাকে শতগুণে সহজ ও উপভোগ্য করে দিলো। হয়তোবা এটা ছিল সৃষ্টিকর্তার উপহার।
উনাদের সাথে পরিচিত হলাম একটু পর একসাথে নিচে নামা শুরু করলাম। এবার একটু ভয় পেলাম। যেহেতু প্রথম পাহাড়ে ওঠা তাই নামার সময় পা কাঁপছিল হালকা। এমনিতেই আমি উঁচু ছাদ থেকে নিচে তাকাতেই ভয় পাই। যাই হোক ভয়কে জয় করে নামতে থাকলাম।
নিচে পৌঁছানোর পর ওই ভাইয়াদের সাথেই চললাম। পরে সারাদিন তাদের সাথেই ঘুরলাম। পাহাড় থেকে নেমেই গিয়েছিলাম সহস্রধারা ঝরনায়, এরপর দুপুরের খাবার খেলাম অলংকার মোড়ের এক রেস্টুরেন্টে। এরপর সিএনজি দিয়ে পতেঙ্গার উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম।
তখন আমরা এতই ক্লান্ত ছিলাম যে পাঁচজনই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর মাথা ঠোক লাগছিল। তবে তা আমাদের ঘুম দূর করতে পারেনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পতেঙ্গা গেলাম এরপর ঘুরাঘুরি শেষে ভাইয়াদের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম বটতলা রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে । এরপর মেইলে করে আবার এক ক্লান্তিক ভ্রমণ শেষে ফিরে আসলাম ইটপাথরের এই শহরে।