• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

দুর্ঘটনা

নয় দফায়ও প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ পুলিশ

কষ্ট থেকে গেল আজীবন

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার একবছর পূর্ণ হলো আজ। বছর পূর্ণ হলেও এ ঘটনায় নিহত ৭১ জনের মাঝে তিনজনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত যেন এগোচ্ছেই না। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দফায় দফায় তারিখ দিয়ে যাচ্ছেন আদালত।

নয় দফা সময় নিলেও বিচারিক আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। এ সুযোগে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়েছেন প্রধান দুই আসামি। ফলে ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কিত স্বজনহারা পরিবারগুলো।

আগুনের সূত্রপাত যে সুগন্ধির গুদাম থেকে, তার মালিকরা এখনো আড়ালেই রয়ে গেছেন। নাম জানা গেলেও তাদের ঠিকানা কিংবা অবস্থান জানা যায়নি। প্রতিষ্ঠানের দুটি কার্যালয়েও তালা ঝুলছে।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনে পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা যান ৭১ জন। এর মধ্যে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ৪ জনের লাশ নিয়ে যায় পরিবারের সদস্যরা। বাকি ৬৭ জনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর বাকি ২২ জনের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে স্বজনদের দেওয়া ডিএনএর নমুনা থেকে আরো ১৯ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে এখনো তিন জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

দুর্ঘটনার পরের দিন‍ ‘অবহেলার কারণে সৃষ্ট অগ্নিসংযোগের ফলে মৃত্যু ঘটাসহ ক্ষতিসাধনের’ অপরাধে চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩২-৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ আসিফ চকবাজার মডেল থানায় মামলা করেন।

মামলায় বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মোহাম্মদ হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ রাখতেন। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন তারা। এ মামলার আসামির তালিকায় রয়েছেন শহীদ ও হাসানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জন ।

মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ১৬ এপ্রিল এজাহারভুক্ত আসামি দুই ভাই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর আগে রিমান্ডে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাদের।

মোহাম্মদ হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ গত বছরের ৮ আগস্ট হাই কোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এই জামিনের মেয়াদ আরো এক বছরের জন্য বাড়িয়ে দেন বিচারপতি আবদুল হাফিজ এবং ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

অন্যদিকে ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলের কাছে পাওয়া সুগন্ধির (বডি স্প্রে) কয়েকটি বোতলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামের সূত্র ধরে জানা গেছে, পার্ল ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠান ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বিদেশি সুগন্ধির রাসায়নিক মজুদ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল সুগন্ধি বোতলজাত করত। সুগন্ধি যেমন দাহ্য কেমিক্যাল, এর সঙ্গে থাকা গ্যাসও দাহ্য। এ কারণে পুরো দোতলা একরকম ‘গ্যাস চেম্বার’ হয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মূল কার্যালয় ছিল পুরান ঢাকার ৬৬ মৌলভীবাজারের তাজমহল মার্কেটে। হাতিরপুলে ১৩/১ নম্বর সোনারগাঁও রোডে কাশেম সেন্টারের ছয়তলায় তাদের আরেকটি কার্যালয় ছিল। এসব ঠিকানায় গিয়ে তালাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। ঘটনার পর থেকে পার্ল ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ কাশিফ এবং দুই পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ ও মোজাম্মেল ইকবাল আত্মগোপনে চলে যান।

এদিকে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মোরাদুল ইসলাম। তিনি বদলি হয়ে গেছেন। মোরাদুল ইসলাম বলেন, মামলার এজাহারে প্রাইভেট কারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ভবনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ওই দুটি নম্বরের কোনো ভবনের মালিক নয় আসামিরা। দুই ভাই ৬৪ নম্বর ওয়াহেদ ম্যানশনের স্বত্বাধিকারী। এসব ভুল থাকায় আসামি প্রথমে জামিন পান।’ এসব বিষয় পরে আদালতকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান পরিদর্শক মোরাদুল ইসলাম।

তিনি বদলি হওয়ায় এখন তদন্ত করছেন পরিদর্শক মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা, চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘যতটুকু জানতে পেরেছি, গোডাউনের মালিক ভারতের মাড়োয়ারি গোত্রের লোক ছিল। বাংলাদেশে তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা, ট্রেড লাইসেন্স- এসব পাওয়া যায়নি। তাদের অবস্থানও শনাক্ত করা যায়নি। এর পরও তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাঁচ-ছয়জনের অবহেলার তথ্য পাওয়া গেছে। এখন যাচাই-বাছাই চলছে।  এ ছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া তদন্ত শেষ করা যাবে না। আগে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছিল, নিয়মিত মামলা হওয়ার পর ওই মামলা শেষ হয়ে গেছে। এখন একটিই মামলা রয়েছে।’ তবে তিনি অবহেলার জন্য দায়ী কারো নাম বলতে রাজি হননি।

গতকাল বুধবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘এখনো তিনজনের মরদেহের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখন যদি কেউ দাবিদার থাকেন, স্বজনরা ডিএনএর নমুনা দিয়ে যান, তাহলে সেসব নমুনা ও মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।’ ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষার কারণেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া আমরা যারা কাজ শুরু করেছিলাম, তাদের অনেকে বদলিও হয়ে গেছেন। গত সপ্তাহে ফরেনসিক বিভাগ এই ডিএনএ রিপোর্ট পায়। এরপর প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ করা হয়।’

ঢাকা মহানগর  দায়রা জজ আদালতের পিপি আবু আবদুল্লাহ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার একটা নির্ভুল প্রতিবেদন আমরা আশা করব। দ্রুতই মামলার চার্জশিট দখিল হবে এটাও আশা করছি। 

মামলার বাদী মোহাম্মদ আসিফ একটি পোশাকের দোকানের বিক্রয়কর্মী। তিনি বলেন, ‘এজাহার পুলিশই ঠিক করে দিয়েছিল। ভবনের মালিক, গোডাউনের মালিক কারা কী আমি তখন কিছুই জানতাম না। এখনো তেমন জানি না। তবে যারাই দায়ী হোক, আমি তাদের বিচার চাই।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads