• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
দপদপিয়ায় বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়

ফাইল ছবি

কৃষি অর্থনীতি

রমজানে জমজমাট মুড়ি ভাজার শিল্প

দপদপিয়ায় বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২২ মে ২০১৯

রমজানে মুড়ির চাহিদা ব্যাপক। তাই এখন মুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত পল্লীগুলো। দম ফেলার সময় নেই। গ্রামের মানুষের এখন খাওয়া-দাওয়াও ভুলে গেছেন। মুড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষ। একই স্থানে সমজাতীয় পেশা জনপ্রিয় হলে সে পেশাকে কেন্দ্র করেই শিল্পের জন্ম হয়। আমাদের জীবন-জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব শিল্প দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক। তবে এ শিল্পেরও অনেক সমস্যা আছে। মেশিনের মাধ্যমে সার মিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করার কারণে এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই মুড়ি গ্রামকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব, মুড়ি গ্রামগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করে আরো অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।

সুনাম আছে ঝালকাঠির মুড়ির...

দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজার পেশাদার বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এ পেশার ওপর নির্ভরশীল এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিনই হওয়ার কথা। একটি নয় দুটি নয়- ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে। এই গ্রামগুলোতে রাতদিন চলে মুড়ি ভাজার কাজ। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, দপদপিয়ায় নাকি বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। মুড়িকে যত সাধারণই ভাবা হোক না কেন, দপদপিয়ার মানুষ প্রমাণ করেছে মুড়ি ভাজাটাই একটা শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা। শুধু ঝালকাঠি নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুড়ি উৎপাদন হয়। কিন্তু ঝালকাঠির মতো একক পেশায় সর্বাধিক জনগণের অংশগ্রহণের কারণেই এ গ্রামের নাম হয়েছে মুড়ি গ্রাম। ঝালকাঠির মুড়ি বিদেশেও সমান জনপ্রিয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এ অঞ্চলের উৎপাদিত মুড়ি।

রোজার মাসকে ঘিরে বেড়ে যায় মুড়ির চাহিদা। উৎসবের আমেজে পরিবারের সবাই মিলে শুরু হয় মুড়ি ভাজার ধুম। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের কয়েক পরিবারের প্রধান ও একমাত্র পেশা মুড়ি ভাজা। দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে সুখ্যাতি পাওয়া এ অঞ্চলের মুড়ি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে এখন বিদেশ বাড়িতেও পাড়ি দিয়েছে। এই এলাকায় প্রতিটি ঘরের নারী-পুরুষ দিন-রাত মুড়ি ভাজার কাজে নিয়োজিত। রোজার আগে এবং রোজার মাসে মুড়ির ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেড়ে যায় মুড়ি ভাজার ধুম। তখন উৎসবের আমেজে পরিবারের সদস্যরা মিলে মুড়ি ভাজে। এখানে দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা হয়। যারা একটু সচ্ছল, তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে আনে। তারপর বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে মুড়ি ভেজে নিজেরাই বাজারজাত করে। আবার যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারা আড়তদারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চাল আনে। এই চালে মুড়ি ভেজে আড়তে সরবরাহ করে। এতে তাদের লাভ কম হয়। তথ্যে জানা গেছে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ২ মণ মুড়ি ভাজতে পারে। এই গ্রামগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পালাক্রমে মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত থাকে। মুড়ি ভাজাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার দেখেছে সচ্ছলতার মুখ। তাই মুড়ি ভাজা এখন গ্রামে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। পাবনার মাহমুদপুর গ্রামের নামও মুড়ি গ্রাম হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে বলে জানা গেছে। মাহমুদপুরের মুড়ি উৎপাদনের জনপ্রিয়তা এখানে পেশায় পরিণত করেছে আশপাশের গ্রাম শ্যামপুর, বিলকোলা, গোপীনাথপুর, ভবানীপুর, রাঘবপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষকে।

কদর বেশি বরিশালের মোটা মুড়ির

রমজান মাস এলেই সরগরম হয়ে ওঠে বরিশালের বুড়িরহাটের মুড়িপল্লী। রাত ২টা বাজতেই মাটির হাঁড়ি পাতিলের টুংটাং শব্দ। মুড়ি ভাজার উৎসবে জ্বলে ওঠে ৩০০ ঘরের এক হাজার ২০০ চুলার আগুন। তৈরি হয় বরিশালের মোটা মুড়ি। বুড়িরহাট ও এর আশপাশ এলাকায় প্রতিদিন তৈরি হয় ২০০ মণ মুড়ি, যা দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে যায়। রমজান আসামাত্র মুড়ির চাহিদা আরো ১০০ মণ বেড়ে যায়। বরিশাল-ঝালকাঠি সীমান্ত এলাকা বুড়িরহাট ও আশপাশের ১০ গ্রামে মোটা মুড়ি বানানো হচ্ছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। স্বাদে অতুলনীয় বলে বরিশালের বুড়িরহাটের মোটা মুড়ির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশের বাইরেও।

শুকনো খাবার রফতানি বাড়ছে

বাংলাদেশে তৈরি শুকনো খাবারের চাহিদা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রবাসী বাঙালিরা এগুলো খাবারের মূল ক্রেতা হলেও এসব খাবারের প্রতি আগ্রহ রয়েছে বিদেশিদেরও। বাংলাদেশ থেকে শুকনো খাবার হিসেবে যেসব পণ্য রফতানি হয়, তার মধ্যে রয়েছে মুড়ি, চিড়া, চানাচুর, আলুর চিপস, বিস্কুট, খই প্রভৃতি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১৯ কোটি ২৮ লাখ ডলারের শুকনো খাবার রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। দেশে তৈরি শুকনো খাবার বেশি রফতানি হয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

ভোলার ভেজালমুক্ত নিরাপদ মুড়ি

ভেজালমুক্ত মুড়ি ভাজায় সুনাম অর্জন করেছেন ভোলার ২টি গ্রামের নারীরা। মুড়ি গ্রাম হিসেবে পরিচিত ভোলার বাপ্তা ইউনিয়নের মুছাকান্দি ও চাচরা গ্রাম। ঢেঁকিছাঁটা চালে তৈরি ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মুড়ি ভাজায় ভোলার এই দুটি গ্রামের মুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন ভাজা এসব মুড়ি যাচ্ছে জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে। এরপর তা বরিশাল হয়ে চলে আসছে রাজধানী ঢাকায়। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এসব গ্রামের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী, বিশেষ করে নারীরা। এই দুই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশাই মুড়ি ভাজা ও বিক্রি। রোজা উপলক্ষে মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। আর তাই দিন-রাত নারীদের পাশাপাশি মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত রয়েছেন পুরুষরাও। মধ্যবাপ্তা ৫ নং ওয়ার্ডের মুছাকান্দি গ্রামের মুছাকান্দি গ্রামের কয়েকশ নারী-পুরুষ মুড়ি তৈরির কাজ করে আসছেন। এসব মুড়িতে ধানের ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়ে শুধু লবণ ও পানি ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয় না। তারা এই মুড়ির নামও দিয়েছেন নিরাপদ মুড়ি। প্রতিদিন এই এলাকায় প্রায় ২০ মণ মুড়ি তৈরি হয়। এ ছাড়া অনেক দূর থেকে মানুষজন চাল নিয়ে তাদের কাছে মুড়ি ভাজাতে আসেন।

সোনারগাঁয়ের মুড়ি নেই তার জুড়ি

১৯৫০ সাল থেকে সোনারগাঁয়ের মুড়ির সুখ্যাতি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাজীরগাঁ, চৌধুরীগাঁ, মঙ্গলেরগাঁ, দুর্গাপ্রসাদ, তাতুয়াকান্দি ও দুধঘাটা গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার ১৯৫০ সাল থেকে হাতে মুড়ি তৈরি করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছে। এসব গ্রামে বছরে প্রায় তিন-চার কোটি টাকার মুড়ি বিক্রি হয়। পেশার সুবাদে গ্রামগুলোর মূল নাম হারিয়ে মুড়ি পল্লী হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। তবে নিশ্চিত করেই তারা বলছেন- এখানকার মুড়িতে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না।  সোনারগাঁওয়ের গ্রামগুলোতে তৈরি হাতে ভাজা মুড়ির রাজধানীর চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে। বাংলার মুড়ি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে  সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, পাকিস্তান, কুয়েত, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ওখানকার পিরোজপুর ও সম্ভুপুরা ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের ঘরে ঘরে রমজান মাসে হাতের ভাজা মুড়ির ধুম পড়ে যায়।

দেশের মুড়ির বিদেশ পাড়ি

বাংলাদেশে তৈরি শুকনো খাবারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিরা এসব খাবারের মূল ক্রেতা হলেও অন্য দেশের নাগরিকের কাছেও বেশ কদর রয়েছে এসব খাবারের। ধীরে হলেও বাড়ছে রফতানি আয়। রফতানিকারকদের তথ্যে দেখা গেছে, তৈরি শুকনো খাবার রফতানির বড় বাজার হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। এর বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্য, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, জাপান, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও শুকনো খাবার রফতানি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার মুড়ি রফতানি হয়। মুড়ি রফতানি করে বছরে ২৫ লাখ মার্কিন ডলার অর্থাৎ সাড়ে ১৮ কোটি টাকা রফতানি আয় হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে আবুধাবি, সৌদি আরব ও কাতার এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরে প্রধানত মুড়ি রফতানি হয়। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের কাছে মেশিনে তৈরি মুড়ির চেয়ে হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদাই বেশি। গত বছরে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টন মুড়ি রফতানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই মুড়ির বেশিরভাগই হাতে তৈরি করা হয়। অপ্রচলিত পণ্য রফতানি উৎসাহিত করতে সরকার ২০ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়ায় গত ক’বছরে  রেকর্ড পরিমাণ মুড়ি রফতানি হয়েছে। চট্টগ্রামের ছোট-বড় ৫০টি প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এই মুড়ি রফতানি করে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে হাতে তৈরি মুড়ির চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। এ কারণে কারখানার চেয়ে হাতে তৈরি মুড়িই বেশি রফতানি হচ্ছে।

কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads