• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
হারিয়ে যাচ্ছে পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র ব্যাঙ

উভচর প্রাণী ব্যাঙ

জীব ও পরিবেশ

হারিয়ে যাচ্ছে পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র ব্যাঙ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৯

ব্যাঙ উভচর প্রাণী, যার অপর নাম ভেক। জাতভেদে ব্যাঙের খাদ্যের ভিন্নতা থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাঙই পোকামাকড় ধরে খায়। এ কারণেই হয়তো বা ব্যাঙকে বলা হয় ‘পোকা মারার প্রাকৃতিক যন্ত্র’। ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে ও মানুষের অনেক উপকারে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সেভ দ্য ফ্রগ’র প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও ইকোলজিস্ট ড. কেরি ক্রিগার এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের ধানভিত্তিক কৃষির জন্য ব্যাঙ অপরিহার্য। তার মতে, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাঙের ভূমিকা অনন্য। ধানসহ নানা ফসলের আবাদে ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইডের ব্যবহার মানুষসহ প্রাণীর স্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ জানা গেছে ব্যাঙ প্রাকৃতিকভাবে ডেঙ্গু, গোদ রোগ, কলেরা, টাইফয়েড, অ্যানথ্রাক্স, ম্যালেরিয়ার মতো অনেক ভয়ঙ্কর রোগবাহী কীটপতঙ্গ খেয়ে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে। একটি ব্যাঙ প্রতিদিন তার দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা খেতে পারে। এ কারণে পরিবেশ রক্ষায় ব্যাঙ সংরক্ষণের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। আবার ব্যাঙ ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় খেয়ে ফসল সুরক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এজন্য ব্যাঙকে ‘প্রাকৃতিক কীটনাশক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ফসলের জমিতে ও আশপাশের ডোবা নালায়, ঝোপঝাড়ে প্রচুর পরিমাণে ব্যাঙ থাকলে তারাই পোকা দমনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। হতাশার খবর হচ্ছে, কীটনাশকের অতি ব্যবহার এবং বন-জঙ্গল উজাড় করায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাকারী ব্যাঙের এখন আর খুব একটা দেখা মেলে না। প্রতিনিয়তই নষ্ট হচ্ছে ব্যাঙের বাসস্থান ও প্রজনন-আশ্রয়।  কৃষিজমিতে ব্যাঙের মলমূত্র ও দেহাবশেষ পচে মাটির উর্বরতা শক্তি এবং ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শস্যক্ষেতের ঘাসফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, পামরী পোকা ও হলুদ মাজরা পোকা খেয়ে উপকার করে। ফলে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। মশা ও ছোট ছোট ক্ষতিকর জীব খেয়ে মানুষের উপকার করে এই ব্যাঙ নামক প্রাণীটি।

উভচর প্রাণী ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। জল ও স্থল উভয় ক্ষেত্রেই এদের অবাধ বিচরণ। প্রজননের পুরো চক্রটা সম্পন্ন করতে এদের পানিতে থাকতে হয় আর পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় এরা ডাঙায় চলে আসে। বিভিন্ন গবেষণতা তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত হারিয়ে যাওয়া প্রাণীটি হচ্ছে ব্যাঙ। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী ১৯৮০ সালের পর পৃথিবী থেকে ২০০ প্রজাতির ব্যাঙ হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের রেড লিস্ট বা লাল তালিকা অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বিপন্ন ব্যাঙের মধ্যে দুই প্রজাতি মহাবিপন্ন, তিন প্রজাতি বিপন্ন ও পাঁচ প্রজাতি সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়। ২৭ প্রজাতি কিছুটা উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ৬ প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় নেই। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, পানিদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন- প্রধানত এই তিন কারণে ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৬টি দেশে আন্তর্জাতিক ব্যাঙ দিবস পালিত হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত উভচর প্রাণী বা ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা ৭ হাজার ৮৩৬। পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাঙ আজ সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থায়। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত নতুন সাত প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে সরকার ১৯৯২ সাল থেকে প্রকৃতির যত্রতত্র থেকে ব্যাঙ ধরা এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করেছে। জলজ পরিবেশ নষ্ট, আবাসস্থল ধ্বংস, জলবায়ুর পরিবর্তন, এবং এক প্রকার ছত্রাক রোগের কারণে আজ ব্যাঙ হুমকির মুখে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যাঙ গবেষক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশে নানা রকমের পাখ-পাখালি, সরিসৃপ, প্রাণীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ও অজানা গোত্রটি হলো ব্যাঙ। ব্যাঙের রয়েছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত, যা অনেকেরেই জানা নেই। ড. মাহমুদুল হাসান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক শেষ করে ২০০৬ সালে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি গবেষণা করে ব্যাঙের নতুন প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন, যা পৃথিবী বিখ্যাত এক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ৪৩ প্রজাতির ব্যাঙ শনাক্ত করে সবগুলোর জীবনরহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে আবিষ্কৃত ব্যাঙের প্রজাতি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। গবেষক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল বা মিঠা পানির অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাঙের চাষ করা যায়। কারণ এখানকার আবহাওয়া ব্যাঙ চাষের অনুকূলে। উৎপাদন ভালো হবে। নতুন আবিষ্কৃত ব্যাঙ দুটির নাম হলো যথাক্রমে গরপৎড়যুষধ সঁশযষবংঁৎর ও গরপৎড়যুষধ সুসবহংরহমযবহংরং। প্রথম ব্যাঙটির নামকরণ করা হয়েছে বাকৃবির মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রয়াত অধ্যাপক ড. মো. মোখলেসুর রহমানের নামানুসারে। কারণ তিনি বাকৃবি ও হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি ‘যৌথ গবেষণা’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশের অবহেলিত আম্ফিবিয়া ধীরে ধীরে বিশ্ব হারপেটোলজিস্টদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাঙটির নামকরণ করা হয় ব্যাঙটি সর্বপ্রথম ময়মনসিংহ জেলার বাকৃবি ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় বলে ময়মনসিংহের নামানুসারে। প্রথমটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল তথা রাউজান ও চট্টগ্রাম এলাকায় এবং দ্বিতীয়টি মধ্য ও মধ্য-পূর্ব অঞ্চল তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় পাওয়া যায়। ড. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে মেলান্দহ, জামালপুরে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (প্রক্রিয়াধীন), ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ব্যাঙের উপকারিতার শেষ নেই। মশা ও ছোট ছোট ক্ষতিকর জীব খেয়ে মানুষের উপকার করে। ভূমিকম্পেরও পূর্বাভাস দেয় ব্যাঙ। যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণীবিদ ড. রাসেল গ্রান্টের গবেষণায় জানা গেছে এ তথ্য। ড. রাসেল গ্রান্ট ইটালিতে ভূমিকম্পপ্রবণ একটি লেকের পাড়ে বেশ কিছু কুনো ব্যাঙের গায়ে ঝুলিয়ে দেন বিশেষ সঙ্কেতযুক্ত যন্ত্র। এই এলাকাতে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। গবেষণার ২৯ দিনের মাথায় ইতালিতে হলো ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প। এর ছয়-সাত দিন আগে থেকে আজব আচরণ শুরু করে গবেষকের ব্যাঙগুলো। পাঁচ দিনের মাথায় নিজেদের আবাস ছাড়তে শুরু করে। এরপর তিন দিনের মাথায় গবেষণাস্থল ছেড়ে কুনো ব্যাঙগুলো চলে গেলো অন্য জায়গায়। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলল গবেষককে। এই ঘটনার তিন দিন পরেই হলো ভয়াবহ ভূমিকম্প। এ ভূমিকম্পের মারা যায় শতাধিক মানুষ। এরপর গবেষক গ্রান্ট জানান, ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে কুনো ব্যাঙ এ ধরনের আচরণ করে না।  ঘরের বাইরে যায় না। বিশেষ এক ধরনের সেন্সর আছে কুনো ব্যাঙের শরীরে। প্রকৃতিই তাকে এই আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি আরো জানান, তার গবেষণাস্থলে চিহ্নিত ব্যাঙগুলো আবার ফিরে এসেছিল তবে ভূমিকম্পের ছয় থেকে সাত দিন পর।

 

ব্যাঙ কেবল প্রকৃতি পরিবেশের বন্ধুই নয়, ব্যাঙের আছে রফতানির সম্ভাবনা। বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ ব্যাঙ খেতে পছন্দ করে। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে খুব সীমিত আকারে ব্যাঙ রফতানি হচ্ছে। বছরে  দেড়  থেকে ২ কোটি ডলারের ব্যাঙ রফতানি করে। অথচ বিশ্বে সারা বছর প্রায় ৩২০ কোটি পিস ব্যাংকের চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি ব্যাঙের মূল্য প্রায় ১৬ ডলার, এ হিসাবে যার মূল্য প্রায় ৫ হাজার ১২০  কোটি ডলার। এর বড় অংশের জোগান দিচ্ছে চীন, ভারত ও মিয়ানমার।

তথ্য উপাত্ত বলছে, ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে ৭৭১ মেট্রিক টন ব্যাঙের পা বিদেশে রফতানি করে ১১.০৯ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। মাছ চাষের মতে কৃত্রিম উপায়ে চাষ করে ইউরোপ বা আমেরিকার বাজারে রফতানি করে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। দেশে একটি ‘ব্যাঙ গবেষণাগার’ তৈরি করার পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় ব্যাঙ যেন যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা এখন সময়ের চাহিদা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাঙের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ব্যাঙের হাড় ও চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী ও শোপিস তৈরি হচ্ছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো আমাদের দেশের মৎস্যচাষিরা মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাঙ চাষ করে বাড়তি লাভবান হতে পারে। ব্যাঙের মাংস অনেক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। উন্নত দেশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ছাড়াও আফ্রিকার অনেক দেশে নিয়মিত খাবারের মেন্যুতে থাকে ব্যাঙের মাংস। আমাদের দেশের চাকমা আর মারমাদের অনেক সুস্বাদু খাবার ব্যাঙের মাংস। ব্যাঙের মাংসকে প্রক্রিয়াজাত করে ফিশ ফিডে প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাঙের দুই পা মানুষের খাবার উপযোগী। অন্যান্য অংশ মাগুর, পাংগাস, চিতল ও আইড় মাছের উৎকৃষ্ট খাবার। আবার পোল্ট্রি খাবার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাঙের মাথায় আবস্থিত ‘পিটুইটারী গ্রন্থি’ মাছের প্রজনন কাজে ব্যবহার করা যায়। ব্যাঙের চামড়া দিয়ে মানিব্যাগ, হাড় দিয়ে মেয়েদের ছোট ছোট গহনা ও বিভিন্ন ধরনের  শোপিস তৈরি করা যেতে পারে। স্বল্প পুঁজি, কম জায়গা, অধিক আয়ের সুযোগ থাকায় ব্যাঙ চাষে ঝুঁঁকি কম, লাভ বেশি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads