• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বেড়েই চলেছে কঠিন শর্তের অনমনীয় ঋণ

এক্সটারনাল রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ (ইআরডি)

ব্যাংক

বেড়েই চলেছে কঠিন শর্তের অনমনীয় ঋণ

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল এমন কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের জন্য সহায়তা নিয়ে আসলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হাত গুটিয়ে ছিল। এর ফলে ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বাংলাদেশে আসা মোট সহায়তার ৮৫ দশমিক ৭০ শতাংশই ছিল দ্বিপক্ষীয়। আর বহুজাতিক সংস্থা থেকে আসে মাত্র ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ সহায়তা। সহায়তার ধরন পরিবর্তনের সুবাদে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছাড় হওয়া মোট সহায়তার ৮৩ দশমিক ৭০ শতাংশই আসে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে। এরপর কয়েকটি দেশ বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করায় আবারো বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। বিদেশি সহায়তায় আবারো বাড়ছে দ্বিপক্ষীয় উৎসের ঋণ। চড়া সুদে অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পে ঋণ নেওয়ায় অর্থনীতিতে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রকাশনা ফ্লু অব এক্সটারনাল রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বহুপক্ষীয় বিভিন্ন উৎস থেকে নামমাত্র সুদে গড়ে আট বছরের রেয়াতকালসহ ৩১ বছরে পরিশোধের সুযোগ নিয়ে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব উৎস থেকে পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে স্বল্প মেয়াদে বাড়তি সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত দুই অর্থবছরে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে ১ হাজার ৯৬০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি এসেছে কঠিন শর্তের দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে। মোট প্রতিশ্রুতির ৫৯ দশমিক ৬৫ ভাগ অর্থ আসবে কঠিন শর্তের ঋণ হিসেবে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৯ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি আসে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। ওই বছর ১ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি হয় কঠিন শর্তে। সর্বশেষ গত অর্থবছরও ৫৩০ কোটি ডলার মূল্যের কঠিন শর্তের ঋণচুক্তি করে সরকার। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কঠিন শর্তের ঋণ কিছুটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে প্রয়োজনের তুলনায় বিনিয়োগের অর্থ সহজ শর্তে পাওয়া সম্ভব হবে না। বাধ্য হয়েই কিছুটা অনমনীয় ঋণ নিতে হচ্ছে। তবে এ ধরনের ঋণে সুদ বেশি থাকার পাশাপাশি পরিশোধের সময় কম থাকায় বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে।

ইআরডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিম্নমাধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য পূরণে পর্যাপ্ত বিদেশি সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। অনুদানের পরিমাণ অনেক আগেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। নমনীয় ঋণের পরিমাণও কমছে। বিশ্বব্যাংক, জাপানসহ বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠান সুদের হার বাড়িয়েছে। ঋণের রেয়াতকালের পাশাপাশি পরিশোধের কালও কমিয়ে এনেছে। এ অবস্থায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ছাড়াও বড় আকারের প্রকল্পে বিনিয়োগের চাহিদা মেটাতে অনমনীয় শর্তে ঋণের অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে প্রাপ্ত বিদেশি সহায়তার ৮৬ শতাংশ অর্থ এসেছিল দ্বিপক্ষীয়ভাবে। এসব সহায়তার সিংহভাগই ছিল অনুদান। ঋণ হিসেবে আসা দ্বিপক্ষীয় সহায়তার সুদের হার ছিল বেশি। পরিশোধের সময়ও ছিল কম। রাষ্ট্র খাতের কল-কারখানা সচল রাখা ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো তৈরির জন্য বাংলাদেশের হাতে তখন বিকল্প ছিল না।

১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক অর্থ সহায়তার মাত্র ১৪ শতাংশ পাওয়া গিয়েছিল বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে।

ইআরডি সূত্র জানায়, ১৯৭১-৭৩ সময়ে বৈদেশিক সহায়তার ৩৮ শতাংশ এসেছিল খাদ্য বাবদ, প্রায় ৫২ শতাংশ উপকরণ ও মাত্র ১০ শতাংশ উন্নয়ন প্রকল্পে। সহায়তার ৮৯ শতাংশ ছিল অনুদান, ১১ শতাংশ ঋণ। ২০০৮-০৯ সালে দেখা যায়, মোট বৈদেশিক সহায়তার ৬৪ শতাংশ ঋণ, অনুদান ৩৫ শতাংশের কিছু বেশি। প্রকল্প সহায়তা বাবদ এসেছে ৯৯ শতাংশ অর্থ, খাদ্য সহায়তা ১ শতাংশের মতো।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রথম সরকার কুৎসিত খাদ্য রাজনীতির শিকার হয়েছিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে বৈদেশিক সহায়তার প্রায় অর্ধেকই এসেছিল খাদ্য বাবদ। সে অবস্থা থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে বাংলাদেশ। খাদ্য খাতে সরাসরি বৈদেশিক ঋণ নেওয়া বন্ধ হয়েছে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে। খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় এখন এ খাতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হয় না। দেশেই এখন ছয় কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। বিদেশি সংস্থা পরিচালিত কিছু প্রকল্পে খাদ্য অনুদান এলেও গত পাঁচ বছরে এর পরিমাণ কমছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে প্রকাশিত ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্স প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবশেষ ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে খাদ্য খাতে দুই লাখ ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে এ খাতে আর কোনো ঋণ নিতে হয়নি। খাদ্য খাতে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৭৬ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ঋণের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে অনুদান। স্বাধীনতার পর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত খাদ্য খাতে ৫৮৮ কোটি ডলার অনুদান পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে গত ৪০ বছরে খাদ্য খাতে ঋণ ও অনুদান মিলে ৬৬৪ কোটি ডলার পাওয়া গেছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এগিয়ে আসে রাশিয়া। দেশটি চট্টগ্রাম বন্দর ও প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল করে দিয়েছিল। তবে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর থেকে রাশিয়া থেকে আর কোনো ঋণ ও অনুদান পাওয়া যায়নি। তবে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে রাশিয়া। এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই ঋণচুক্তি হয়েছে। দেশটি থেকে অস্ত্র আমদানি করতেও ঋণচুক্তি করেছে সরকার। তবে কঠিন শর্তে চড়া সুদে এ দুটি ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। এ পর্যন্ত ১ হাজার ২২১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশটি ছাড় করেছে ১৬৪ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরের পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৮৮ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ১২৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

ইউরোপের অন্যতম দেশ জার্মানি স্বাধীনতার পর প্রথম দুই বছর বাংলাদেশকে কোনো সহায়তা করেনি। তবে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে দেশটির নিয়মিত সহায়তা পাওয়া গেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে খাদ্য ও পণ্য খাতে ঋণ ও অনুদান বন্ধ হয়ে যায়। এখন শুধু প্রকল্প খাতে স্বল্প পরিমাণ অনুদান পাচ্ছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৫১ কোটি ৮৩ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দেশটি ছাড় করেছে ২০২ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।

স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি ফ্রান্স। তবে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে খাদ্য, পণ্য ও প্রকল্প খাতে সহায়তা দেওয়া শুরু করে দেশটি। তবে ২০০০ সাল থেকে খাদ্য ও পণ্য খাতে ফ্রান্সের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প খাতে অনুদান ও ঋণ বাবদ যা পাওয়া যেত, তাও বন্ধ হয়ে গেছে ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশে সহায়তা আবার চালু করেছে ফ্রান্স। ১২০ কোটি ১৭ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ফ্রান্স থেকে এ পর্যন্ত এসেছে ৬৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার।

স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও এগিয়ে আসে ভারত। তবে গত চার দশকে খাদ্য খাতে কোনো সহায়তা করেনি দেশটি। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে খাদ্য, পণ্য ও প্রকল্প খাতে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। ৮০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) এবং ২০ কোটি ডলারের অনুদানের মাধ্যমে দেশটি ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ঋণ সহায়তা আবার শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০০ কোটি ডলার ও ৪৫০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয় দেশটি। কয়েক বছরে ৬৫১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দেশটি ছাড় করে ৬২ কোটি ৭ লাখ ডলার।

শুরু থেকেই চীন থেকে বাংলাদেশ অল্পবিস্তর সহায়তা পেলেও দেশটি বিভিন্ন প্রকল্পে বড় অঙ্কের সহায়তা দিতে শুরু করে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ, সড়ক ও রেল খাতের বেশ কিছু বড় প্রকল্পে বাংলাদেশকে ৫৭৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। এর মধ্যে ১৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার ছাড় করেছে দেশটি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২২৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার সহায়তা দিয়েছে চীন সরকার।

স্বাধীনতার পর থেকে কানাডা বাংলাদেশের খাদ্য, পণ্য ও প্রকল্প খাতে সহায়তা দেওয়া শুরু করে। গত চার দশকে ২২১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাওয়া গেছে কানাডা থেকে। এর মধ্যে ২২০ কোটি ডলারই হচ্ছে অনুদান। বাকি এক কোটি ডলার ঋণ হিসেবে পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দেওয়া শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। খাদ্য ও উপকরণ খাতে এ সহায়তা দিয়ে আসছিল। এ পর্যন্ত দেশটি বাংলাদেশকে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে।

 

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads