• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
প্রকৃতিতে শীত ঋতুর উপস্থিতি 

ছবি : সংগৃহীত

বৈচিত্র

প্রকৃতিতে শীত ঋতুর উপস্থিতি 

  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন আমাদের বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশে প্রত্যেক ঋতু তার নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। পৌষ ও মাঘ মাস— এ দু’মাস শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকে শীতের সূচনা হতে দেখা যায়। শীতের আগমনে পত্রকুঞ্জে, জলে-স্থলে সর্বত্র একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়তাগ্রস্ত শীতের নির্মম বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য ও রিক্ততার বিষাদময় প্রতিমূর্তি রূপে শীতের আবির্ভাব ঘটে। শীত আসে শূন্যতা আর জড়তা নিয়ে। হেমন্ত আর বসন্তের মাঝে শীত আসে সসংকোচে। তার হিমশীতল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে তপস্যার কঠোর আত্মপীড়ন এবং বৈরাগ্যের ধূসর মহিমা। রিক্ততার মধ্যেই তার আগমন, রিক্ততার মধ্যেই তার পরিচয়। শীতের সকাল থাকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এমনও দিন যায়, শীতের সকালে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সূর্যের খোঁজ মেলে না আকাশে। ঘন কুয়াশার আড়ালে সূর্য থাকে ঢাকা। শীতের সকালে আকাশে মেঘের দেখা মেলে না, কিন্তু ছড়িয়ে থাকে ঘন কুয়াশা। শীতের আগমনে জীবনের চাঞ্চল্য ম্লান হয়ে আসে। কনকনে শীতের তীব্রতায় পৌষের পিঠা আর মাঘের খেজুরের রসের মিষ্টি মধুর শুভাগমনে ঘরে ঘরে বয়ে আনে উৎসবের সমারোহ। শিশির ভেজা ভোরের উদীয়মান রবির কিরণে বাড়ির উঠোনকে আলোকিত করে। তখন রোদে পিঠ ফিরিয়ে বাড়ির আঙিনায় পিঠা পায়েস ও মুড়কি মোয়ার আনন্দে সবাই আস্বাদন করে শীতের রূপ বৈচিত্র্যকে। গাম্ভীর্যময় বৈশিষ্ট্যের জন্য শীতের সকাল বছরের অন্য ঋতুর সকাল থেকে স্বতন্ত্র। কবি সুকান্ত তাই বলেছেন— ‘শীতের সকাল/দরিদ্রের বস্ত্রের আকাল/শীতের সকাল/অসাম্যের কাল/ধনীর সুখ আর আনন্দ/শ্রেণি সংগ্রাম এ নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব।’ 

শীত মৌসুমে ফসল তোলা মাঠে দিগন্তব্যাপী কি সীমাহীন শূন্যতা বিরাজ করে! কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি শিশির সিক্ত রাস্তাঘাট, হিমেল বাতাসের মিষ্টি মধুর আমেজ শীতকালে এক ভিন্ন রূপ বয়ে নিয়ে আসে। পত্র-পল্লবহীন গাছপালাকে অলঙ্কারশূন্য বিধবা বলে মনে হয়। গাছে পাতা নেই, ফুল নেই, মাঠে ফসল নেই। কর্মমুখর পৃথিবী যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। শীতকালে আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যায়। সকাল বেলা নদীর পানি থেকে কুয়াশার ধোঁয়া সৃষ্টি হয়ে কুণ্ডলী আকারে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করে। 

শীতের ঋতুতে শহরের বিভিন্ন রকমের দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড শীতেও কাক-ডাকা ভোরে শহরবাসীর ঘুম ভেঙে যায়। শীতের সকালে শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানগুলো জমজমাট কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। অথচ শহরের দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের কাছে শীত আসে অভিশাপ হয়ে। রেলস্টেশন বা রাস্তার ধারে দেখা যায় পথশিশুরা একটু উত্তাপের জন্য একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। প্রচণ্ড এই হিমশীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তাই ব্যাহত হয়। 

শহরের পাশাপাশি গ্রামে শীত এক ভিন্নরূপ নিয়ে আসে। শীত নিবারণের জন্য দরিদ্র মানুষেরা আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে উত্তাপ নেয়। শিশুরা চাদর মুড়ি দিয়ে মক্তবে যায়। অনেক সময় প্রচণ্ড শীতে বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যুও আমরা পরখ করি। ফলে শীত নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য বয়ে নিয়ে আসে একরাশ দুঃখ আর কষ্ট। তবু নতুন ফসল, শাক-সবজি আর পিঠা-পায়েসের আয়োজনে শীতকাল হয় মুখরিত। এ ঋতুতে গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। যাত্রার আসর বসে। বাংলা ভাষার কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত শীতকাল নিয়ে রঙ্গরস ভরা কবিতা লিখেছেন। ঠান্ডা পানি যে কত ভীতপ্রদ তা বর্ণনা করে ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন— ‘জলের উঠেছে দাঁত, কার সাধ্য দেয় হাত/আঁক করে কেটে লয় বাপ,/কালের স্বভাব দোষ, ডাক ছাড়ে ফোঁস ফোঁস/জল নয় এযে কাল সাপ।’ 

শীতঋতুতে বিত্তবানদের গরম কাপড়ের প্রদর্শনী আর নিঃস্ব মানুষের শীত-কাতরতার অগ্নিপরীক্ষার ভেতরেও বাংলার প্রকৃতিতে মন ভোলানো রূপ সব শ্রেণির মানুষের মুখেও ফুটিয়ে তোলে হাসি। আর তাই শীতের আমেজ বাংলার আবহমান ঋতুচক্রের ধারায় এ দেশের মানুষের কাছে হয়ে ওঠে উপভোগ্য। শীতের সকাল একদিকে শীতের রিক্ততা ফুটিয়ে তোলে শুকনো ঝরাপাতার মাঝে। অন্যদিকে ঘাসের ডগার ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুর শোভা প্রকাশ করে শীতের স্নিগ্ধতা। সর্বত্যাগী শীত তার সর্বস্ব ত্যাগ করে আমাদের খামার পূর্ণ করে দিয়ে নীরবে চলে যায়। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা। এই ত্যাগের অপরূপ মহিমা তার সর্বাঙ্গে ভাস্বর। কুঞ্জে কুঞ্জে মৃত্যুর বিপ্লব। তবু রিক্ততার তপস্যা শেষে আছে পূর্ণতারই আশ্বাস। বাংলা ষড়ঋতুর মধ্যে তাই শীতঋতু চির জাগরূক হয়ে আছে।

 

জোবায়ের আলী জুয়েল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads