• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
সিলেট-১ আসনে মর্যাদার লড়াইয়ে ১০ প্রার্থী

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

নির্বাচন

সিলেট-১ আসনে মর্যাদার লড়াইয়ে ১০ প্রার্থী

  • আবু তাহের চৌধুরী, সিলেট
  • প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

সিলেট-১ আসন। সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনসহ দেশের সংসদীয় সকল আসনগুলোর মধ্যে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত। সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যতোটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে এর সবগুলোতেই সিলেট-১ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন সেই দলই সরকার গঠন করে বসেছে রাষ্ট্র ক্ষমতায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই ৪৭ বছরের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে, ১৯৭৩ সালে সিলেট-১ আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল হাকিম চৌধুরী। এরপর ১৯৭৯ সালে বিএনপির সৈয়দ রফিকুল হক, ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে খন্দকার আব্দুল মালিক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ২০০১ সালে বিএনপি থেকে সাইফুর রহমান, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে আবুল মাল আব্দুল মুহিত নির্বাচিত হন। এ সকল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে তাদের দলগুলোই।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর ধারাবাহিকতা থাকবে নাকি ব্যতয় ঘটবে তা এখন দেখার বিষয়। আর এ দৃশ্য দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সিলেট-১ আসনে এবার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০ জন ভোটার।

এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে চূড়ান্ত প্রার্থীতা করছেন ১০জন প্রার্থী। এর মধ্যে রয়েছেন মহাজোট থেকে আওয়ামী লীগের ড.এ.কে আব্দুল মোমেন (নৌকা প্রতীক), জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিএনপির খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির (ধানের শিষ প্রতীক), জাতীয় পার্টির মাহবুবুর রহমান চৌধুরী (লাঙল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. রেদওয়ানুল হক চৌধুরী (হাতপাখা), ইসলামী ঐক্যজোটের (আইওজে) মুহম্মদ ফয়জুল হক (মিনার), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ইউসুফ আহমদ (আম), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির উজ্জল রায় (কোদাল), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের প্রণব জ্যোতি পাল (মই), বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মো. আনোয়ার উদ্দিন বুরহানাবাদী (হারিকেন), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মাওলানা নাসির উদ্দিন (বটগাছ)।

সিলেট-১ থেকে প্রধান দুইটি জোট থেকে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে দুই নতুন মুখকে। আওয়ামী লীগ থেকে সিলেট-১ আসনে ভোটযুদ্ধে আছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বিএনপি থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের। ড. মোমেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আপন ছোটভাই। আর খন্দকার মুক্তাদির সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আবদুল মালিকের ছেলে। দুজনই প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন।

দীর্ঘদিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। কয়েক বছর হলো তিনি দেশে ফিরেন। বড়ভাই আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অবসর নেয়ার কারণে দেশের বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের মনোনয় পান তিনি।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন খন্দকার আব্দুল মালিক। প্রয়াত এই নেতার ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির এবার এ আসনে বিএনপির কান্ডারি। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ব্যবসায়ী হলেও দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সাথে জড়িত। ২০১৬ সালের ৬ আগস্টে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-ব্যাংকিং ও রাজস্ব সম্পাদক হিসেবে খন্দকার মোক্তাদিরকে মনোনীত করা হলেও এর তিন দিন পরই তা সংশোধন করে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয় তাকে। ১ আসনে মুক্তাদিরের সাথে মনোনয়ন দৌঁড়ে ইনাম আহমদ চৌধুরী থাকলেও শেষ পর্যন্ত মুক্তাদিরের ভাগ্যেই জোটে চূড়ান্ত মনোনয়ন।

ড. মোমেন নগরীর ধোপাদিঘীর পূর্বপারের হাফিজ কমপ্লেক্সের প্রয়াত এ.এ আবদুল হাফিজের ছেলে। তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা পিএইচডি। বর্তমানে তিনি শিক্ষকতা ও অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন। তার নামে কোনো মামলা নেই। নেই কোন ঋণও। ‘শিক্ষকতা, পরামর্শক ইত্যাদি পেশা থেকেই তার সবচেয়ে বেশি আয় হয়। এ পেশা থেকে তিনি বছরে ২৭ লাখ ৪১ হাজার ২২৪ টাকা আয় করেন। এছাড়া  তিনি বাড়ি ভাড়া থেকে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪২৪ টাকা, ব্যবসা থেকে ৩৮ হাজার ৮৩৩টাকা, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে আয় ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৯০ টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আয় বছরে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন।’ অস্থাবর সম্পদ হিসেবে তার নিজ নামে রয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫২১ টাকার সম্পদ। এর মধ্যে নগদ আছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৩হাজার ৭১০টাকা। এছাড়া স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার ৫০ ভরি সোনা ও ৩ লাখ টাকার আসবাবপত্র রয়েছে। আর স্থাবর সম্পদের মধ্যে তার নিজের নামে ৪ কোটি ২৪ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৫ টাকার সম্পদ। এর মধ্যে ২২ লাখ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি, ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৫ টাকা মূল্যের দালান এবং ৩ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার টাকা মূল্যের বাড়ি ও এ্যার্পার্টমেন্ট আছে তার।

আর বিএনপিতে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মোক্তাদির সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত খন্দকার আবদুল মালিকের ছেলে।এক সময়ে সিলেট বিএনপির কাণ্ডারি ছিলেন খন্দকার আবদুল মালিক। তার হাত ধরেই সিলেট বিএনপির বীজ বপন হয়। সিলেট-১ আসনে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন খন্দকার মালিক। ১৯৯১ সালে সিলেটের ১৯টি আসনের মধ্যে কেবল এই আসনেই বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রার্থী হয়ে সিলেটের রাজনীতি দখলে নেন হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান। ২০০৮ পর্যন্ত তারই আধিপত্য ছিল সিলেটে।

এরপর পিতার আসন উদ্ধার করতে রাজনীতির মাঠে নামেন খন্দকার আব্দুল মালিকের ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির।

১৯৮৯ সালে ছাত্র অবস্থায় সিলেট পরিবহন সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। শিক্ষাজীবনে সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি নেন।

খন্দকার মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৫ টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে; এছাড়া একটি মামলায় তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। পেশায় আমদানি-রপ্তানিকারক, বস্ত্র প্রস্তুতকারক ও ক্যামিক্যাল প্রস্তুতকারক তিনি। তার মালিকানাধিন ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব ব্যবসা থেকে বছরে তার আয় ১ লাখ ৯০ হাজার ৬৬৫ টাকা। তা স্ত্রী ব্যবসা থেকে ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং এপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে ৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আয় করেন। হলফনামা অনুযায়ী স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তালিকায় খন্দকার মুক্তাদির ও তার স্ত্রীর দু’জনই প্রায় সম পরিমাণ সম্পদের মালিক। এর মধ্যে মুক্তাদিরের নিজ নামে সর্বমোট ৭ কোটি ৯৬ লাখ ৭৭ হাজার ৭৪৩ টাকা ও তার স্ত্রীর নামে আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার ৫১ টাকার অস্থাবর সম্পদ। আর স্থাবর সম্পদ হিসেবে যৌথ মালিকানায় ৪০ শতক অকৃষি জমি ও উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্ত ৪ লাখ টাকার ১০ শতক জমি। ঢাকার কাফরুলে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি, ময়মনসিংহের ভালুকা ও হাজিরবাজার ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকার জমি, ঢাকার গুলশানে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকার ৫ কাটা জমি। যৌথ মালিকানায় রয়েছে উত্তরায় ৪০ লাখ টাকার জমি। স্ত্রীর নামে গুলশানে রয়েছে ৬৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার দুটি এপার্টমেন্ট। ৩টি ব্যাংকে তার ৯ কোটি ১৪ লাখ ৬ হাজার ৯৯৭ টাকার ব্যবসায়িক ঋণ রয়েছে। এছাড়াও ৯ কোটি ৪১ লাখ ২৬ হাজার ৯৯৭ টাকার একক ঋণ রয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক হওয়ার সুবাদে তার নামে ৬টি ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৩০৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪৮ টাকা। তবে সকল ঋণই পুনঃতফসিলী করা রয়েছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে খন্দকার মুক্তাদির রাজনীতির মাঠে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দলীয় কোন্দল আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সকল ভেদাভেদ ভুলে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করছেন তিনি।

চূড়ান্ত মনোনয়ন পূর্বে যে আরিফুল হক চৌধুরী ইনাম আহমদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দিতে কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সেই মেয়র আরিফুল হকের কার্যালয়ে গিয়েও করেছেন সৌজন্য সাক্ষাত।

সিলেট-১ আসনে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় পার্টির মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। স্বশিক্ষিত এই প্রার্থী পেশায় হিসেবে নিয়েছেন জমিদারীকে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এই আসনে রয়েছেন মাওলানা রেদওয়ানুল হক চৌধুরী রাজু। তিনি করছেন দুটি মাদ্রাসার শিক্ষকতা। ইতোমধ্যে তিনি এ আসনের বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহতামিম, শায়খুল হাদীস ও শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় সভা করেছেন।

ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী মুহাম্মদ ফয়জুল হক। তিনি দাওরায়ে হাদিস (এমএ সমমান) পাশ। তার নামে জালালাবাদ থানার একটি জিআর মামলা রয়েছে; যা তদন্তাধীন। তিনি মাদ্রাসার শিক্ষকতা করেন।

বাসদ-মাকর্সবাদী মনোনীত প্রার্থী উজ্জল রায়। তিনি বিকম (সম্মান) পাশ। পেশায় সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী। তার কোনো ধরণের আয় নেই।

ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন ইউসুফ আহমদ। এইচএসসি পাস এই প্রার্থী হলফনামায় পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসা। মোটরসাইকেল ক্রয় বাবদ তার নামে একটি ঋণ চলমান আছে।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হলেন প্রণব জ্যোতি পাল। পেশায় শিক্ষক এই প্রার্থীর স্থাবর সম্পদের মধ্যে যৌথ মালিকানায় ০.০৭ একর জমিতে টিনশেডে বাসা আছে তার।

খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা নাসির উদ্দিন। তিনি নগরীর জামিয়া ইসলামিয়া শাহ গাজী বুরহানুদ্দিন (রহ.) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এ পেশা থেকে তার বাৎসরিক আয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছেন মো. আনোয়ার উদ্দিন বুরহানাবাদী।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads