• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
অন্ধজনে দেহ আলো

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

অন্ধজনে দেহ আলো

  • প্রকাশিত ০৪ নভেম্বর ২০১৮

অন্ধজনে দেহ আলো— বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সময়ে নতুন করে ভেবে দেখা জরুরি। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকেই কিছু বলতে চাই। বোধ হওয়ার পর প্রথম যখন জানতে পারলাম অন্ধ মানুষ সম্পর্কে, তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। চারদিকে বারবার তাকিয়েছি আর নৈসর্গের অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমিসহ পৃথিবীর অনেক কিছুই মুগ্ধ চোখে হূদয়ভরে অবগাহন করেছি। সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের তীব্রতা বেড়েছে অন্ধ মানুষজনের কথা ভেবে। একজন মানুষ দিনে কতবার যে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে, তার হিসাব কষে শেষ করা যাবে না। অথচ আমাদের আশপাশেই অনেক মানুষ আছে যারা কিছুই দেখতে পায় না, এমনকি জীবনে একবার নিজের চেহারাটাও দেখার সৌভাগ্য হয় না। আহা! কতটা অসহায় অবস্থা তাদের। আমাদের যাদের চোখ আছে, তারা এই মুহূর্তে একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন তো কী অনুভব হয়! চারদিকে ঘোর অন্ধকার, একবারে নিঃশ্বাসের কাছে যে বস্তুটি আছে সেটিও দেখা যায় না। ভাবা যায়! এই অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে অন্ধজনরা। জন্মগতভাবে একটি শিশু যখন অন্ধ হয়ে জন্মায়, তখন হয়তো ভাবে পৃথিবীর সবাই এমন, হয়তো তার মতোই আর কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু যখন সে জানতে পারে তার মতো সবাই নয়, তার আশপাশের সবাই দেখতে পারে তখন হয়তো দুঃখের সীমা থাকে না। এক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা তাদের সহ্য ক্ষমতাও তখন বাড়িয়ে দেন। অন্যথায় এ বেদনা সহ্য করার মতো শক্তি মানবকুলের হতো না।

অনেকে জন্মগতভাবেই অন্ধ হয়ে জন্মায় আবার অনেকে নানা কারণে অন্ধ হয়ে যায়। নানাবিধ দৃষ্টিত্রুটি, গ্লুকোমা, আঘাত, চক্ষুরোগ, ডায়াবেটিস, রেটিনোপ্যাথিসহ নানা ধরনের সমস্যার কারণে অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। একটি তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ অন্ধত্বের শিকার। এর মধ্যে আমাদের দেশে ৭ লাখ মানুষ অন্ধ, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ছানিজনিত অন্ধত্ব যা সুচিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য। কেবল অর্থনৈতিক দীনতা ও সচেতনতার অভাবে এ অবস্থা হচ্ছে। যদিও হাতের নাগালে এখন চোখের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সমাজের বিত্তবান ও ডাক্তারদের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে হবে।

আমাদের সমাজে অনেক অন্ধ মানুষই ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। আমার বয়স তখন সাত কি আট, প্রতিদিন বিকালে অপেক্ষা করতাম সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভিক্ষুক অন্ধ লোকটির জন্য। তিনি রোজ না এলেও সপ্তাহে তিন-চারদিন আমাদের বাড়িতে আসতেন। ওই লোকটির সঙ্গে একটি বালকও আসত, যে তাকে পথ দেখাত। সারাদিন ভিক্ষা শেষে যা আয় হতো, তা-ই দিয়ে সংসার চালাত। আমি তখন ভাবতাম, অন্ধ মানুষরা মনে হয় অন্য কোনো চাকরি করতে পারে না। যেহেতু চোখে দেখে না, সেহেতু পড়তেও মনে হয় পারে না। পরে বাবার মুখে শুনে একরকম শান্তিই পেয়েছিলাম যে, তাদের জন্য লেখাপড়ার সুব্যবস্থা আছে। দৃষ্টিজয়ী ফরাসি বালক লুই ব্রেইল একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা ব্রেইল নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্রেইল পদ্ধতি না থাকলেও শ্রুতিলিখন পদ্ধতির মাধ্যমেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। সময়ের পালাক্রমে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে, বলা যায় আধুনিকতার শীর্ষে এখন আমরা।

ব্রেইল ব্যবহারকারীরা রিফ্রেশ্যাবল ব্রেইল ডিসপ্লে ব্যবহারের মাধ্যমে কম্পিউটারের পর্দা বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক সমর্থনযোগ্য ডিভাইসে পড়তে পারে। কাজেই অন্ধ ছেলেমেয়েদের জন্য লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এখন তেমন কোনো অসাধ্য কাজ নয়। তবে আবার একেবারে সহজ কথাও নয়। সাধারণত সরকারি বা বেসরকারি কোনো স্কুল-কলেজে ব্রেইল পদ্ধতি নেই। শহর, উপশহর এবং গ্রামগুলোতেও সাধারণ কোনো স্কুল নেই, যেখানে অন্ধ শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে। কমপক্ষে সরকারি যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোতে যদি অন্ধ ছেলেমেয়েদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে তাদের জন্য আরো সহজ হতো। প্রতিটি স্কুলে না হোক, অন্তত ইউনিয়নভিত্তিক একটি স্কুলে একজন বা দুজন করে ব্রেইল পদ্ধতিতে পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে ওই ইউনিয়নে কোনো অন্ধ ছেলেমেয়ে থাকলে তাদের জন্য শিক্ষার দরজা আরো প্রশস্ত হতো। সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

 

সোলায়মান মোহাম্মদ

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads