• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
১২ নভেম্বর ১৯৭০ : এক বিভীষিকাময় ঘূর্ণিঝড়ের কথা

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

১২ নভেম্বর ১৯৭০ : এক বিভীষিকাময় ঘূর্ণিঝড়ের কথা

  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০১৮

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত সমুদ্র উপকূলীয় মানুষের কাছে আজো এক আতঙ্কের রাত হিসেবে পরিচিত। ৮ নভেম্বর মধ্য বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং ১২ নভেম্বর আরো ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল অতিক্রম করে। বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নোয়াখালী ও ভোলা জেলা। এতে মারা যায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। একমাত্র ভোলার চরতজুমদ্দিন উপজেলায় ৭৭ হাজার লোক মারা যায়। এশিয়ায় এ ধরনের কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য এ রকম- ১৮৩৯ সালে ভারতে নিহতের সংখ্যা ৩ লাখ; ১৮৮১ সালে ভিয়েতনামে ৩ লাখ; ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে নিহত হয় ৫ লাখ; ১৯৭৫ সালে চীনে ২ লাখ ২৯ হাজার; ১৯৯১ সালে আবারো বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন এবং ২০০৮ সালে মিয়ানমারে নিহত হয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৩ জন।

আমি তখন নোয়াখালী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে টেলিভিশন চালু হলেও তখনো নোয়াখালীতে গিয়ে পৌঁছেনি। গুগুল, ইন্টারনেট বা মোবাইল ছিল অজানা। খবরের মাধ্যম ছিল রেডিও এবং পত্রিকা। তখন রেডিও বা পত্রিকার পক্ষে দ্রুত খবর সংগ্রহ করার সুযোগ ছিল না। ১২ নভেম্বর আকাশ সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। রেডিও এবং মাইকে বলা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ ৪নং সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে এবং সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন এবং দুর্যোগ বিভাগ মাইকে প্রচার করছে। কিন্তু, বক্তা এবং শ্রোতা, কারো কাছেই সংবাদটা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এর মূল কারণ মাত্র ১৮ দিন আগে অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর এভাবেই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ব্যাপক প্রচারও করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তখন দেওয়া হয়েছিল ১০নং সঙ্কেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। এমনকি বড় আকারের জোয়ারও হলো না। তাই ১২ নভেম্বর কেউ তেমন প্রস্তুতি নেয়নি। সন্ধ্যার পর হতেই বাতাস জোরে বইতে শুরু করেছে। রাত যত গভীর হচ্ছে, বাতাসের বেগ ততই বাড়ছে। আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছি। আমার বাসার গৃহকর্মী, আমরা তাকে ইসমাইলের মা বলেই ডাকতাম। তার বাড়ি চরাঞ্চলে। সে বলল, এটা কোনো সাধারণ ঝড় নয়, আমি মেঘের গতি দেখেই বুঝতে পেরেছি। আমার মন বলছে, আমার বাড়িঘর কিছুই নেই। ক্রমেই বাতাসের বেগ কমছে, ভোরের আলো ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমাদের মনে হয়েছে, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। সূর্য ওঠার আগেই ইসমাইলের মা হেঁটে তার বাড়ির উদ্দেশে বের হয়ে গেল।

বেলা ৯টায় লোক মারফত জানা গেল, জোয়ার এবং ঢেউয়ের আঘাতে চরাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহু লোক মারা গেছে। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত জনতা ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় অবহেলার জন্য জেলা প্রশাসকের অফিসে হামলা করে। ক্রমেই দুর্যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই অবহিত হতে থাকে। বিবেকের তাড়নায় আমিও ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার সহকর্মী এবং বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ৮ জনের একটি গ্রুপ গঠন করলাম। আমরা আমাদের নিজেদের বাসা এবং প্রতিবেশীর বাসা হতে বেশকিছু কাপড়, চিড়া-মুড়ি, খাবার পানি, দিয়াশলাই ইত্যাদি জরুরি মালপত্র নিয়ে চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। জেলা প্রশাসন আমাদের উদ্যোগ দেখে আমাদেরকে একটি জিপ দিল। সোনাপুর হতে দক্ষিণে ওয়াপদা বাজার পর্যন্ত বেড়ি বাঁধের পাশে দেখলাম শুধু লাশ আর লাশ। আর স্বজনহারা মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার আপনজনকে। ওয়াপদা বাজার পর্যন্ত গিয়ে আর যাওয়া সম্ভব হলো না। এরপর আর বেড়িবাঁধের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় না। আমরা জিপ হতে নেমে প্রত্যেকে একটা করে বস্তা মাথায় নিয়ে সেখান হতে ১০ মাইল দূরে পূর্ব চর-বাটার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। তাতেও আমাদের ক্লান্তি নেই। আমাদের লক্ষ্য প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে কেউ যাবে না, সেখানে পৌঁছানো। রাস্তার দুই পাশে শুধু লাশ আর লাশ। দিন প্রায় শেষ, সূর্য ডুবছে, অন্ধকার নেমে আসছে। আমরাও ক্লান্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই মালামাল বিলি করব। পাশেই দেখলাম ঝোপের ভেতর হতে এক মহিলা ডেকে বলছে— বাবারা, আমাকে একটা কাপড় দাও। আমরা কাপড় নিয়ে এগুলে, সে বলছে, এদিকে এসো না, কাপড় ছুড়ে মার। আমরা তাই করলাম। মহিলা কাপড় পরে সামনে আসলে, আমরা তাকে চিড়ামুড়ি খেতে দিই। মহিলা কিছু না খেয়ে কাঁদতে থাকে। তার দুই ছেলে এক মেয়েকে স্রোতে নিয়ে গেছে। সে জানে না তারা জীবিত না মৃত। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। তার শরীর ক্ষতবিক্ষত। চিকিৎসা করবে কোথায়? এরও কোনো উত্তর আমাদের জানা ছিল না। আমাদের সামনেই পড়ল এক লোক। একটি মৃতদেহ গলায় দড়ি বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দেখায় আমাদের নিকট অমানবিক মনে হলেও, আমরা কোনো বিকল্প পথ দেখাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলে বলল, এটা আমার ভাই। সারাদিন খুঁজে, এই মাত্র তার মৃতদেহ পেলাম। বাড়িতে নিয়ে মাটি দেব। মাটি দেওয়া মানে, মাটিচাপা দেওয়া। সূর্য ডুবে গেছে, আমাদের ত্রাণ বণ্টনও শেষ। এখন ফেরার পালা। সমস্যা হলো, চারদিকে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। তদুপরি রাস্তার উপর হাঁটুপানি। দিনে লাশ দেখে হাঁটার সুযোগ ছিল, এখন লাশের ওপর দিয়েই হাঁটতে হচ্ছে। অনেক কষ্টে রাত প্রায় ১২টায় আমরা ওয়াপদা বাজারে পৌঁছলাম। ভাগ্য ভালো, সেখানে একটি জিপ পাওয়া গেল। জিপে উঠে আমরা রাত ৩টায় সোনাপুর কবরস্থানে পৌঁছলাম। এখানে লাশের মেলা। লাশ আনছে আর গর্ত করে মাটিচাপা দিচ্ছে। একটি গর্তে ১০-১২ জন করে মাটি দেওয়া হচ্ছে। ভোর ৪টায় বাসায় ফিরে আসলাম। ২৪ ঘণ্টা পর বাসায় ফিরলাম। শরীর ক্লান্ত, তাই সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লাম। দুই ঘণ্টা পরেই আমার সঙ্গীরা এসে নিয়ে গেল। পূর্ব দিনের মতোই আবার ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে জিপে ওয়াপদা বাজার হয়ে চরবাটা। এভাবেই চলল প্রায় সাত দিন। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সাহায্য সংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের সেনা সরকারের কোনো প্রতিনিধি দেখতে আসেনি বা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পরেই ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে পাকিস্তানি শাসকদলের অবহেলার উচিত জবাব দেয় বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি এবং জাতীয় পরিষদে ৩০০  আসনের মধ্যে লাভ করে ১৬০টি আসন। এত বড় বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ইসলামের দোহাই দিয়ে শুরু করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। বীর বাঙালি দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। ক্ষমতায় যে থাকুক, সে একজন বাঙালি। দেশের মানুষের জন্য তার দরদ থাকবে, তাই তো স্বাভাবিক।

 

এম এ গোফরান

লেখক :  চেয়ারম্যান, আইডিইবি গবেষণা সেল

gofran1948@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads