• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
 কেটে যাক সন্দেহ-সংশয়ের ধূম্রজাল

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

কেটে যাক সন্দেহ-সংশয়ের ধূম্রজাল

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচনী হাওয়া বইছে সারা দেশে। উৎসবের আমেজ যেমন আছে, তেমনি আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তিরিশ তারিখের ভোট কতটা সুষ্ঠু ও অবাধ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের দোলাচলে রয়েছেন দেশবাসী। দুই তারিখে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে যাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই বিএনপির। বিশদলীয় এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরও কয়েকজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। বাঘা বাঘা কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়ন নাকচ হয়েছে। যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, তারা নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন এবং করছেন। আশা করা যায় তাদের অনেকেই প্রার্থিতা ফিরে পাবেন। তবে সেটা জানা যাবে আট তারিখের মধ্যে। বেগম জিয়ার প্রার্থিতা বাছাইয়ে টিকবে না, মোটামুটি সবারই তা জানা ছিল। অন্য যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, সেখানেও আইনের মারপ্যাঁচ আছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো রিটার্নিং অফিসারের বিচার-বিবেচনা ঠিকভাবে কাজ করেনি বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার রিটার্নিং অফিসারদের ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন  মনোনয়নপত্রের ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে যেন কারো প্রার্থিত বাতিল করা না হয়। কিন্তু পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হয়, অনেক কর্মকর্তা সিইসির ব্রিফিংয়ের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। দিলে এমনটি ঘটতে পারত না। শাসকদলের প্রতি তাদের আনুগত্যটা বোধহয় যতটুকু আশা করা হয় তার চাইতেও বেশি। বাংলা বাগধারায় এই ধরনের কাজের একটা সুন্দর নাম আছে। সেটা হলো ফফর দালালি। ফফর দালালরা আগ বাড়িয়ে এমনসব কাজ করে বসে, যাদের জন্যে করা হয়, তারাও এতে বিব্রত হন। তবে এও ঠিক যে, দু হাজার তেরো ও চৌদ্দ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট অনির্দিষ্টকালের অবরোধের নামে যে হঠকারি রাজনীতি করেছে, এখনো তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে। মামলার ভারে বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকের পিঠ কুঁজো হয়ে গেছে।

এসব নিয়ে বেশি কথা বলা নিরাপদ নয়। সেলফ সেন্সরশিপ জরুরি। যতদূর বুঝতে পারা যাচ্ছে সরকার দেশে একটি ভালো ইলেকশন করতে চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে এবং সে নির্বাচনটি হবে গ্রহণযোগ্য। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং ফ্রি ফেয়ার ইলেকশনের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। এরশাদের শাসনামলে ’৮৮ সালের ইলেকশন ছাড়া সব নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক ছিল। ছিয়াশির নির্বাচনে আওয়ামী লীগও অংশ নিয়েছিল। আরো অনেক দল সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন ফেয়ার ছিল না। ফেয়ার হলে সেবারই এরশাদ সরকারের পতন ঘটত।

ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের জন্য সবার আগে দরকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। দলমত নির্বিশেষে সব প্রার্থী নির্বাচনী আইন মেনে প্রচার-প্রচারণার সমান সুযোগ পাবেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেবে না, বিঘ্ন করবে না। নির্বাচনকালীন প্রশাসন সব প্রার্থীর নিরাপত্তা দেবে এবং আইন মেনে চলা হচ্ছে কি না, সেটা দেখবে। কেউ আইন অমান্য করলে আইন নির্দেশিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রত্যেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন নির্ভয়ে। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দেবেন। কোনো অবস্থাতেই একজনের ভোট অন্য কেউ আগেই দিয়ে দেবে না। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং অতিবৃদ্ধ কোনো নাগরিক বিশ্বস্ত কারো সাহায্য নিতে পারেন। ভোট দিয়ে ভোটার সাধারণ বাড়িও ফিরে আসবেন নির্বিঘ্নে। নির্বাচনের আগে ও পরে কোনোভাবেই ভোটারকে কেউ ভয় দেখাবে না।  ভোটের আগে বা পরে কোনোরকম ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না, তার নিশ্চয়তা বিধান করা।

কিছুদিন আগে মাঠপর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে একজন কমিশনার বলেছিলেন, বিশ্বের কোথাও শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। আমাদের দেশেও হবে না। কোনো ইলেকশন কমিশনার এ ধরনের কথা কী করে বলতে পারেন! তার দাবিটি তথ্যভিত্তিকও নয়। ইউরোপের দেশগুলোতে এখনো একশভাগই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। যুক্তরাজ্যেও কেউ জালভোট দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। যতদূর জানি সে দেশে ভোট দেওয়ার পর কোনো ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালিও লাগিয়ে দেওয়া হয় না। কেননা কোনো ভোটার একবার ভোট দিয়ে আবার ভোট দিতে আসবেন, এমনটি তাদের মাথার মধ্যেই নেই। আরেকজনের ভোট চুরি করে বা জোর করে দিয়ে দেওয়ার মতো হীন মানসিকতা ইউরোপের কোনো ভোটার পোষণ করেন না। নিজের বিবেকের কাছে অতটা ছোট হওয়ার চাইতে ভোটের দিন কেন্দ্রে না যাওয়া তারা বেশি পছন্দ করেন। খবর নিয়ে জেনেছি সুইডেনেও একই অবস্থা। ভোট কাউন্টিংয়ে কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেলেও অবিলম্বে তারা সেটা সংশোধন করে নেন। এজন্য কোনো আন্দোলন বা মামলা-মোকদ্দমার প্রয়োজন হয় না। আমেরিকায়ও জালভোট হয় না। ভোটকেন্দ্র দখল করে নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে জুনিয়র বুশের নির্বাচনে অন্তত একটি রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে বলে নালিশ রয়েছে। তবে এখনো তা প্রমাণ হয়নি। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বের বিকাশমান গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নাগরিকদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সেই আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে ওঠেনি অনেক ক্ষেত্রে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে জালভোট দিয়ে তরুণদের কেউ কেউ গৌরববোধ করে, লজ্জাবোধ করা তো দূরের কথা। সাংবিধানিক পদে থেকে নিজের বিবেককে চোখ ঠাওরান কেউ কেউ। আত্মমর্যাদাবোধের ধারে-কাছেও তারা যান না। শিক্ষিত হয়ে কতটা কুশিক্ষা তারা লাভ করেছেন, সেটা তারা প্রদর্শন করেন। স্রষ্টা হেদায়েত না করলে এদের বিবেককে কে জাগাবে! বিকাশমান গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এরাই সুষ্ঠুতার প্রতিপক্ষ।

বাংলাদেশ সেরকম কোনো দেশ নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা এনেছি স্বাধীনতা। গণতন্ত্র আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার। দেশের মালিক জনগণ। দেশ পরিচালিত হবে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী। প্রতি পাঁচ বছর পর দেশের মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটান। পছন্দ অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। কারা দেশ পরিচালনা করবেন, আইন প্রণয়ন করবেন, তার দায়িত্ব অর্পণ করেন নির্বাচিত পার্লামেন্টের ওপর। অতীতে আমাদের দেশে অবাধ নির্বাচনের যেমন দৃষ্টান্ত রয়েছে, তেমনি আছে জালিয়াতিপূর্ণ কিংবা একতরফা ভোটের দৃষ্টান্ত। চৌদ্দ সালে কোন পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন হয়েছিল তা কমবেশি সবারই জানা। দশ বছর পর আজ আবার জাতীয় নির্বাচন সামনে এসেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে, দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ নির্বাচন সম্ভব। যারা এটা বিশ্বাস করতে চাইছেন না, তাদের বিশ্বাসের ভিত তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কথায় কথায় ষড়যন্ত্র খোঁজার দরকার নেই। ভালো নির্বাচন হলে কারো মনে ষড়যন্ত্র থাকলেও সেটা মনের মধ্যেই মরে যাবে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীদের মনে অনেক সন্দেহ। ইসির কথা ও কাজ অনেক ক্ষেত্রে সে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সদস্যের আত্মশ্লাঘায় লাগার কথা। এ অবস্থাটি তাদের জন্যে সম্মানজনক নয়। আমাদের বিশ্বাস করতে সাধ হয়, অনভিজ্ঞতার কারণেই হোক বা মনের ভুলেই হোক, ইলেকশন কমিশনের কিছু কিছু ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এখন সময় সামনে তাকানোর, অতীতের ভুল শুধরে নেওয়ার। আইন নির্বাচন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। ইলেকশন কমিশন চাইলে ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না কেউ। সিভিল প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পিছপা হবে না। পুলিশ প্রশাসনও কমিশনের নির্দেশনার বাইরে যাবে না। ইলেকশনের আগেই ভোটার সাধারণের মধ্যে যাতে পিনিক সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা একান্ত কর্তব্য। আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে নানাজনে নানা কথা বলেন। কিন্তু এও তো সত্য যে পুলিশ সদস্যরা অনেক ভালো কাজও করেন। জঙ্গি দমনে, মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সাফল্যও দেখিয়ে চলেছেন। তারা জনগণের বন্ধু। নির্বাচনে কাউকে হারিয়ে বা জিতিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়। এ কাজ তারা কেন করতে যাবেন! অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে কারা ক্ষমতায় আসবেন, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে। হয়তো দেশবাসী পাবেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রাণবন্ত পার্লামেন্ট। দেশের জন্য আজ সেটাই বেশি দরকার।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক saleheenfa@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads