• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
কৃষি ও কৃষক বাংলাদেশের প্রাণ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

কৃষি ও কৃষক বাংলাদেশের প্রাণ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

জলবায়ুর পরিবর্তন, বিরূপ আবহাওয়া, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক সব বাধা পেরিয়ে কৃষিই বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশে বর্ধিত ধান উৎপাদনের সফলতা সব বৈদেশিক আয়কেও হার মানিয়েছে। পরিবেশের প্রতিকূলতা পেরিয়ে হারিকেন আর ক্যাটরিনার যুগে বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ধান উৎপাদনে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। উদ্ভাবন করেছে বন্যা, খরা ও লবণাক্তসহিষ্ণু ধান। এভাবে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তবে আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কথা বললে আমার দেশের কৃষকের কথাও বলতে হবে। কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রামবাংলার কৃষক। কৃষকরা স্বভাবগতভাবে প্রকৃতির উদ্ভাবক। তারা অসীম সৃজনী ক্ষমতার অধিকারী। খাঁটি ও সাদা মনের মানুষ। কৃষকরাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক।

দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি কৃষির সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ জনসম্মুখে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া শেষ ভাষণে সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে চাই না। আমি চাই বাংলাদেশের কৃষক ভাইদের কাছে, যারা সত্যিকারের কাজ করে; যারা প্যান্ট পরা-কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই— জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। তাহলে কারো কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষির উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই দেশের উন্নতি করা সম্ভব। তিনি কৃষিতে দক্ষতা অর্জন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের আবশ্যকতা বুঝতে পেরে নিজের ছেলেকে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে না পাঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত কৃষক তৈরি করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। কাজেই কৃষিই বাংলাদেশের ভরসা এবং ভবিষ্যৎ। দেশ-বিদেশের গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও বলছে, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে কৃষিতে মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিই পথ দেখাবে।

কৃষি মানে এখন আর শুধু ধান, পাট আর কিছু শস্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নেই। কৃষি এখন একটি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার নাম। যেখানে সারা বছর ফলানো হয় সবজি, ফল, মাছচাষ, গবাদি পশুপালন এমনকি কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনাও হচ্ছে। তবে কৃষির অন্যতম সাফল্য দেশে ধান উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে উৎপাদন স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করে রেশনে দেওয়া হতো। ’৭১-এ স্বাধীনতার পর এদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি, আর এখন জনসংখ্যা ১৭ কোটি। তার মানে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অপরপক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। আবার নগরায়ণ প্রবণতায় কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। মাত্রাতিরিক্ত সার ও বিষপ্রয়োগের ফলে কমছে মাটির উর্বরাশক্তি। কৃষিজমি সংরক্ষণে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেই। এশিয়ার প্রতিটি কৃষিনির্ভর দেশে কৃষিজমি সুরক্ষা আইন কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের টাটা কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গরে কৃষিজমিতে কারখানা করতে চাইলে লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও সরকার অনুমোদন দেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে অনুমোদন বা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই কৃষিজমির যথেচ্ছাচার অপব্যবহার হচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্ধিত ধান উৎপাদনে তাদের গবেষণা পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে লবণাক্তসহিষ্ণু ধান আবিষ্কারের ফলে লবণাক্ত জমিতেও বাম্পার ফলন হতে শুরু করেছে। এ জাতের ধানের চাহিদা চীন, ভারত, ইরাক, সিয়েরালিয়ন, ঘানা, গাম্বিয়া, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল প্রভৃতি দেশেও ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশে যেসব ধান উৎপাদিত হচ্ছে, তার ৮০ ভাগ ধানই এসব উন্নত জাতের। ফসলের আগাছা নির্মূল, ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়ার কাজ, বীজ বপন, সার ও কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজের জন্য ব্রি’র গবেষণা বিভাগের নেতৃত্বে আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। শস্য, সবজি, ডাল, মসলা, ফলসহ  বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারি’। গবেষণায় নতুন নতুন উন্নত জাতের ধান ও উন্নত যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের দেশে কৃষকের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না বলেই অনেক সম্ভাবনা মাঠে মারা যায়। কোনো সূত্র বা পরীক্ষার সুযোগ ছাড়াই যুগের তালে এই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলার কৃষক। আমরা জানি ঝিনাইদহের সাধারণ কৃষক হরিপদ কাপালির অবিস্মরণীয় ধান আবিষ্কার দেশজড়ে সুনাম কুড়িয়েছে। কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। মতানুযায়ী, দেশের বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ এলাকা চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি জলাবদ্ধসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা গেলে বছরে আরো ৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্লটের মতো দেশের ৮২ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে ধান, গমসহ অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। কৃষি বিভাগের গবেষণায় বলা হয়, শুধু সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এক ফসলি প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যাবে। এ ছাড়া অস্থায়ী অনাবাসীদের মালিকানাধীন বৃহত্তর সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে পতিত থাকা প্রায় ৭০ ভাগ জমির ৫০ শতাংশে বোরো, আউশ ও আমন ধান চাষ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে পরিত্যক্ত ও পতিত প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপকূলীয় ১৪ জেলার আবাদযোগ্য ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮১ হেক্টর চলতি পতিত জমি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হলে উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে।

কৃষি খাতের বিকাশ ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে চাল, সবজি, আলু, ফলসহ কৃষিজ উৎপাদন বাড়ছে। আধুনিক ও বহুমুখী করা সম্ভব হলে কৃষিপণ্য রফতানির সম্ভাবনাও আরো বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে গঙ্গাবাঁধ বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে ৬৫ লাখ হেক্টর জমি তিন ফসলি হিসেবে উন্নীত হবে। জাতীয় উৎপাদন আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। কাজেই কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য কৃষকের কথা বলতে হবে। কৃষকের কথা শুনতে হবে। কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, সেচ সুবিধা, সার সুবিধা, বীজ সুবিধা এবং কৃষিক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত মতবিনিময় পর্যবেক্ষণ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা জরুরি। এসব ইতিবাচক দিক নিয়ে সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সচেতন জনগণ কৃষকের পাশে দাঁড়ালে অসাধ্য সাধন করবে বাংলার কৃষকরা।

 

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads