• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বইপড়ায় অনীহা কেন

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বইপড়ায় অনীহা কেন

  • ইমানুল সোহান
  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮

একটি জাতিকে স্বনির্ভর জাতিতে রূপায়িত করার জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন। যে জাতির জনগোষ্ঠী যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি স্বনির্ভর ও উন্নত। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও গুণগত শিক্ষার হার বাড়ছে না। যার ফলে বেকারের হার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। যার প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা। দিনের পরিক্রমায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বইপ্রেমীর সংখ্যা বাড়ছে না। যতই দিন যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বই পড়ার প্রতি অনীহা দেখা যাচ্ছে। শখের বসে বইপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারে কম। কেন বই পড়তে অনীহা শিক্ষার্থীদের?

কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থীদের বই পড়তে অনীহা দেখা দিচ্ছে। প্রথমত অভ্যাস। সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- মানুষ অভ্যাসের দাস। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনে আপনি যা-ই অভ্যাস করবেন, তারই ফল উপভোগ করবেন। বয়সভেদে অভ্যাসের তারতম্য রয়েছে। একটি শিশুর অভ্যাস গড়তে সহযোগিতা করে তার বাবা-মা। এক থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা-মায়ের অনুকরণে শিশুরা বেড়ে ওঠে। বর্তমানে আমাদের শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, তা সবার জানা। বর্তমানে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য অধিকাংশ বাবা-মা টিভি সিরিয়ালগুলোকে বেছে নিয়েছেন। বিদেশি কার্টুনের দৃশ্য দেখিয়ে তাদের খাওয়ানোর অভ্যাস করা হচ্ছে। এখন শহর পেরিয়ে তা গ্রামাঞ্চলেও প্রবেশ করেছে। তা থেকে তারা কোনো জ্ঞান অর্জন করছে না। বরং তারা ছোট থেকে বিদেশি ভাষা শিখছে।

দ্বিতীয়ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বইবিমুখ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। যখন একটি শিশুকে প্লে কিংবা নার্সারিতে পড়ার সময় ১০টি বই পড়তে হয়, তখন কীভাবে তারা আনন্দের সঙ্গে বই পড়ার অভ্যাস করবে? ক্লাসের পর কোচিং, বাসায় ফিরে প্রাইভেট। এই চাপের মুখে তারা জ্ঞান অর্জন করছে ঠিকই; কিন্তু তা ভালোবাসা ও আবেগের পড়ালেখা নয়। বরং সেটা প্রতিযোগিতার পড়ালেখা। এই প্রতিযোগিতায় তাদের টিকতে হলে পাঠ্যবই পড়ার বিকল্প নেই। কারণ পাঠ্যবই ছাড়া ভালো ফলাফল সম্ভব নয়। আর ভালো ফলাফল করতে না পারলে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। এই অসুস্থ ভালোর পেছনে ছুটতে গিয়ে বইপড়া থেকে সরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এটা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লক্ষ করা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কেন বইবিমুখ? কেন তারা শিক্ষাজীবন শেষে হতাশায় ভুগছে? এর প্রধান কারণ হলো তারা বইকে ভালোবাসতে শিখছে না। যার ফলে গবেষণা হচ্ছে না। এর জন্য আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা দখল করতে পারছে না। এর জন্য দায়ী যেমন শিক্ষার্থীরা, তেমনি দায়ী শিক্ষকরাও। কারণ শিক্ষকরা গবেষণাধর্মী পড়ালেখা থেকে বিমুখ। তবে সব শিক্ষক নন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকের ক্ষেত্রে সেটিই সঠিক। যার ফলে শিক্ষার্থীরাও বিমুখ।

তৃতীয়ত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে। নতুনত্বের আভায় বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছি আমরাও। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট এখন বহুল জনপ্রিয়। সব থেকে জনপ্রিয় ফেসবুক। এখন সব স্তরের শিক্ষার্থীর ফেসবুক আইডি থাকাটা স্বাভাবিক। ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করছে। যার ফলে তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা বইপড়ার মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। শুধু পরীক্ষামুখী লেখাপড়ায় আগ্রহী হচ্ছে। কিন্তু নিজের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে দিন শেষে রেজাল্ট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। ফলে জাতি পাচ্ছে মেধাহীন শিক্ষিত।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ‘বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। এই ব্যবহারকারীর ৯১ শতাংশই ফেসবুক ব্যবহার করে। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৬৩ লাখ নারী ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। অর্থাৎ যারা ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের মধ্যে তরুণ ও তরুণীর সংখ্যাই বেশি।

চতুর্থত, মানসম্মত বইয়ের অভাব। এখন অমর একুশে বইমেলায় হাজারো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি লেখকের বই পাঠকরা গ্রহণ করে। এখন বইপ্রেমীর সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি মানসম্মত লেখকের সংখ্যাও অপ্রতুল। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে।

বইপড়ার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা জানতে হলেও বই পড়ার প্রয়োজন। কবি, সাহিত্যিক ও মনীষীরা বই পড়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে গেছেন। জীবনে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা কী তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বইপোকা প্রমথ চৌধুরী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও মহাত্মা আহমদ ছফার লেখা পড়লে বোঝা যায়। কাল-সচেতন লেখক প্রমথ চৌধুরী ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে তা তুলে ধরেছেন। একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই তাকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে হবে। বই পড়া সম্পর্কে বিল গেটস বলেছেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার নানা ধরনের স্বপ্নের পেছনে একটা বড় কারণ ছিল বই পড়া। বৈচিত্র্যময় বই পড়ার কারণেই আমি অনেক বেশি স্বপ্ন দেখতাম।’ এরকম স্বপ্ন আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে খুব কমই লক্ষণীয়। এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ ভালো রেজাল্ট ছাড়া, ভালো চাকরি মেলে না। আর ভালো ফল লাভের জন্য পাঠ্যবই পড়ার বিকল্প নেই।

খ্যাতিমান আরবি সাহিত্যিক আল জাহিজ বলেছেন, ‘ভালো বই এমন এক সঙ্গী যা অমঙ্গল, অকল্যাণ ও বিরক্ত করে না। এটা এমন এক প্রতিবেশী যা আপনার ক্ষতি করে না। বইয়ের পাতাগুলো পাঠকালে আপনার অনুভূতি শক্তিশালী ও মেধা তীক্ষ হয়।’ আল জাহিজের কথায় প্রতীয়মান হয়, বই পড়লে কখনো অকল্যাণ হয় না, বই জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে।

তরুণদের বইমুখী করার জন্য স্কুল পর্যায়ে লাইব্রেরির ব্যবস্থা করতে হবে। সেসব লাইব্রেরিতে জীবনে সফল হওয়া ব্যক্তিদের বই থাকা জরুরি। এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় ভালোবাসার বইপ্রেমী তৈরি হয় না, সে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। এতসব সমস্যা পেরিয়ে তরুণদের বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে তলাবিহীন ঝুড়ির মতো জ্ঞানহীন তরুণ সমাজই থাকবে এ দেশে।

 

লেখক : সাংবাদিক, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads