• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
গণতন্ত্র : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপরিহার্য উপাদান

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্র : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপরিহার্য উপাদান

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বহুল উচ্চারিত স্লোগানগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্যতম। ভাষণে-বক্তৃতায় এই চেতনার কথা বলা হচ্ছে নিরন্তর। বিজয়ের মাসে এই চেতনার প্রশ্নটি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বোধগম্য কারণেই। এই চেতনার আলো জনে জনে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে, নতুন প্রজন্মকে এই মহতী চেতনায় আলোকিত করে তোলার জন্যে গড়ে উঠেছে অনেক সংগঠন। এবারের সাধারণ নির্বাচনেও এই ইস্যুটি সামনে আনা হচ্ছে বার বার।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ- এই দুটিকে কখনোই আলাদা করা যায় না। বাংলাদেশের অস্তিত্বে লীন হয়ে রয়েছে মহান এই চেতনা। তারপরেও যখন আলাদা করে এই চেতনাটিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্ন উঠছে, তখন বুঝতে হবে কোনো না কোনোভাবে মহান এই চেতনার জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন কোনো কোনো মহল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি! কখনো কখনো মনে হয়, এই চেতনার কথা বলে বলে যারা পেরেশান, তাদেরও অনেকে এর অন্তর্গত তাৎপর্য বোঝেন অথবা বুঝতে চান না। তারা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে এবং নিজেদের হাইলাইটেড করার জন্যে এই স্লোগানটিকে ব্যবহার করতে চান। মহান এই চেতনার স্বরূপটি  আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যে চারটি মূলনীতি স্থির করা হয়, সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পরে সংবিধানের বহু কাটাছেঁড়া হলেও এই চারনীতি থেকে বাংলাদেশ সরে যায়নি, যদিও ব্যাখ্যায় তারতম্য ঘটানো হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোনো বিতর্ক নেই। শাসনতন্ত্রে পরিষ্কার বলা রয়েছে, মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা ছিল গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক পন্থায় শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা আমাদের অভীষ্ট। পরিতাপের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা সঞ্চারিত করেছে যে গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্রই এদেশে শরবিদ্ধ হয়েছে বার বার।    

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুব কাছে চলে এসেছে। আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। সারা দেশের মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু এখন তিরিশ তারিখের ভোটানুষ্ঠান। সুরক্ষিত থাকবে কি সাধারণের ভোটের অধিকার! জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে কি ভোটের রেজাল্টে! জনে-জনে, মনে-মনে সন্দেহ-সংশয়ের দোলাচল। আকাশে রৌদ্র-মেঘের খেলা দেখে জনসাধারণ কখনো আশায় বুক বাঁধেন, কখনো হতাশ। ঠিক বুঝে উঠতে পারা যাচ্ছে না কী ঘটতে যাচ্ছে দিনের শেষে। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন। বিএনপিসহ বিরোধী দল ও জোটের নেতারা বলছেন, সমতল মাঠ তৈরি হয়নি, তৈরি হতে দেওয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। বিরোধী দল দমনে পুলিশ সক্রিয় বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে। গ্রেফতার থেমে নেই।  নকল ব্যালটপেপার ছাপিয়ে জালভোট দেওয়ার কৌশল করা হচ্ছে- এরকম গুরুতর অভিযোগও তোলা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে যে নেতিবাচক রিপোর্ট উপস্থাপিত হয়েছে, জনগণের বিবেচনায় তা এখন পর্যন্ত অসত্য বলে  প্রমাণিত হয়নি। এর উল্টো দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তারা ধানের শীষের অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করলেও আপিলে ইলেকশন কমিশন অধিকাংশের প্রার্থিতা ফিরিয়ে দিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব এ জন্যে সন্তোষও প্রকাশ করেছেন। এটা একটা ভালো খবর। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চলেছে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার। নেতারা বলছেন, তারা মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বেন। দেশে ভোট বিপ্লব হবে। দেশের মালিক জনগণ। জনগণকে সেই মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে তারা সংকল্পবদ্ধ। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। জনগণ ভোট দিলে তারা আবার ক্ষমতায় আসবেন, না দিলে নাই। প্রধান নির্বাহীর এরকম  সোজা-সাপ্টা বক্তব্যের পর অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবে সন্দেহের ঘুণপোকা মানুষের মন থেকে যাচ্ছে না। তার পারিপার্শ্বিক অনেক কারণও রয়েছে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। পত্রিকার পাতায় এবং টেলিভিশনের পর্দায় সব খবরই আসছে। সবাই তা দেখছেন, জানছেন। বিএনপি শেষপর্যন্ত ভোটে থাকবে কি-না, তা নিয়ে ইদানীং আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আকারে-প্রকারে সন্দেহ প্রকাশ করে চলেছেন। যেদিন রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিচারে বিএনপির বহুসংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেল, সেদিন দলটিকে নির্বাচন থেকে সরে না যাওয়ার অনুরোধ করলেন তিনি। গত রোববার আবার সংবাদ সম্মেলনে বললেন, বিএনপি যদি সরে না যায়, তাহলে ইলেকশন হবে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার। জনমনে প্রশ্ন, বিএনপির নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা এলো কেমন করে! দলটি তো একবারো বলেনি যে, তারা সরে যাবে। বরং মির্জা ফখরুল শেষপর্যন্ত থাকার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।

হাওয়া থেকে পাওয়া সন্দেহ জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে বৈকি! ক্ষমতাসীন দল কি তাহলে বিএনপিকে ইলেকশনের মাঠ থেকে হটিয়ে দিতে চাইছে! অবশ্য প্রচারণার কৌশল হিসেবে ধানের শীষের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যেও এমন কথা বলা হয়ে থাকতে পারে। সব মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে ‘কী জানি কী হয়’- এমন একটা ভাবনার মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষ। 

উপসংহারে আমাদের চিন্তা করে দেখার বিষয় এই যে,       তিরিশ তারিখের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে কিংবা না হলে- তার ফল কী দাঁড়াবে? কোনোরকম ঘোরপ্যাঁচ ছাড়াই এই বিপ্রতীপ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ভোট অবাধ হলে, জনগণ যদি নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে পারে এবং ফলাফলে যদি কোনো কারসাজি হতে না পারে, তা হলে সেটা হবে মূলগতভাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় বিজয়। আর বিপরীত কিছু ঘটলে সেটা হবে মক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয়। বাঙালির এই গভীরাশ্রয়ী চেতনার কথা বলে যত স্লোগানই দেওয়া হোক না কেন, যত সংগঠন, যত ক্যাম্পেইন হোক না কেন, সবই হয়ে যাবে তখন অর্থহীন। মনে রাখা দরকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটি তৈরি করেছিল পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক শাসন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তার প্রতি শাসকগোষ্ঠী যদি সম্মান দেখাতো তাহলে বাঙালির হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। বস্তুত একাত্তরে দেশমাতৃকার মুক্তি এবং গণতন্ত্রের লড়াই জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক সমান্তরাল রেখায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবেশদ্বার হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। এর মধ্য দিয়েই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকসাধারণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে পার্লামেন্টে পাঠান। আর পার্লামেন্ট দেশ পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন ও নীতি-নির্দেশনা প্রদান করে। পার্লামেন্টই বেছে নেয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। কাজেই অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হতে পারে না। প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না কোনো গণতান্ত্রিক সরকার। ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশনে জিতে কারা সরকার গঠন করবে, সেটা বড়কথা নয়। জনগণের  পছন্দের সরকার দেশ চালাবে সেটাই বড়কথা। জয়যুক্ত হবে গণতন্ত্র। সমুন্নত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পক্ষান্তরে মানুষ যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে না পারে, যদি কারসাজি হয়, নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়- সে হবে গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়ার শামিল। মলিন হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। 

এক দশক পর দেশে সাধারণ নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়েছে। সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যেও মানুষ পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। চৌদ্দ সালের নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল না, তা সবাই জানেন। এতদিন পর যে শস্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, পঙ্গপালের আক্রমণে তা যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার সব মহলের।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

saleheenfa@gmail.com 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads