• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি

  • প্রকাশিত ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু। রাষ্ট্রকে আগে চিহ্নিত করতে হবে কোথায়, কোন খাতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। দেখা যায়, সরকারি সেবাধর্মী খাতে বেশি দুর্নীতি হয়। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির কথা জানা গেল। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সেবাধর্মী খাতগুলোতে মানুষের চলাচল বেশি থাকে। তাই দুর্নীতিও বেশি হয়। এক বছরের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। সেবা খাতে বছরে দুর্নীতি হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ঘুষ-দুর্নীতি হয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, জিডিপির ০ দশমিক ৬ শতাংশ। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি বেশি হয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দুর্নীতি সহনশীল মাত্রায় আনা সম্ভব। যদিও গোটা বিশ্বই এ সমস্যার মোকাবেলা করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা।’ অর্থাৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের অবস্থান আবারো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ হাসিনা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি।  পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ।’ তিনি আরো বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী করে আধুনিকায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা করবে সরকার।

দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক দল চাই, দুর্নীতিমুক্ত নেতা চাই, দুর্নীতিমুক্ত সরকার চাই, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই। সরকারি-আধা সরকারি অফিস থেকে দুর্নীতি দূর করতে পারলে জাতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাবে। আইনের দোহাই দিয়ে অথবা গ্রেফতার করে সরকারি অফিস থেকে সাময়িকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ তো গেল দুর্নীতির কথা। সুশাসন নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সুশীল সমাজ আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সুশাসন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পেতে হলে শাসনের পাশাপাশি কাউন্সিলের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও তাদের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের জনসংখ্যার একটা অংশ, বিশেষ করে ধনিক শ্রেণি, ব্যক্তি ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের কথা চিন্তায় নেয় না। এদের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যয় করা হয় না। নিরাপত্তাজনিত কারণে এরা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে থাকেন। এদের প্রভাবে ব্যাংকিং সেক্টর আজ অস্থিতিশীল। অনেক সময় পুঁজি সাইফোন্ড হয়ে যায়। আমাদের পুঁজিপতিরা এ দেশের যে অর্থ উপার্জন করেন, তা যদি মানুষের স্বার্থে ব্যয় করেন তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর এমন সঙ্কটের মুখে পড়ত না। হিসাবমতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়। এর মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি হয় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও দুর্নীতিবাজরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যদিও অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় না। এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ দাখিল করে। দুদক নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও সরকারের সদিচ্ছায় দুদকের প্রতি এখনো মানুষের আস্থা রয়েছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করতে পারবে- এ ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে। তবে ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দুদকের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্ত করতে হবে। নতুবা এ আইনের অপব্যবহার হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু কিছুসংখ্যক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রয়োজনে বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল তার মূল দর্শন। বাংলাদেশে আজ যে ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, দলবল নির্বিশেষে তারা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। এদের কারণে উৎপাদিত ফসলের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। শেখ হাসিনার প্রকট দৃষ্টি গরিব মানুষের দিকে। কিন্তু শ্রেণিস্বার্থে সচেতন ধনিক শ্রেণি সৃষ্ট সম্পদ এককভাবে উপভোগ করতে চায়। গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণের কথা তারা মোটেই ভাবে না। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে এদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শোষক শ্রেণির বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্নীতি আজ উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে উন্নয়ন তৎপরতার গতি থমকে যাবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দেশ ও জাতির চরম শত্রু দুর্নীতিবাজরা। আইনের প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিরোধী দল নয়, সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

একেএম দেলোয়ার হোসেন

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads