• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
সিনেমা হলের সোনালি অতীত

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সিনেমা হলের সোনালি অতীত

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ২০ মার্চ ২০১৯

হলে বসে সিনেমা দেখার সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে অনেক আগেই। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশের বহু সিনেমা হল আজ মার্কেটে পরিণত হয়েছে। জেলায় জেলায় সিনেমা হল থাকলেও উপজেলাগুলোতে খুব কমই সিনেমা হল রয়েছে। কারণ একের পর এক লোকসান হওয়ায় হল মালিকরা সিনেমা হল চালিয়ে নিতে ইচ্ছুক নন। এটাই স্বাভাবিক। অথচ একসময় দেশের সিনেমা হলগুলো রমরমা ব্যবসা করেছে। এই পর্যায়ে এসে ভাবাই যায় না একসময় মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মিলে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে দেশের মানুষ। তারপর সেই সিনেমা নিয়ে পরিবারে গল্প-গুজবও হয়েছে। সিনেমা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখানো হতো। হলের দর্শকরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতো। কী চমৎকার সেই দৃশ্য। এই দৃশ্য খুব বেশি বছর আগের নয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই দৃশ্য গল্পের মতো। এখন সিনেমা হলমুখী দর্শকের সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু কেন এমন হলো?

সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে খুব বেশি বছর হয়নি। চলচ্চিত্রে একসময় গতানুগতিক সিনেমার সংখ্যা বাড়তে লাগল। দর্শকেরও সিনেমার প্রতি আগ্রহ কমতে লাগল। সেই একধরনের গল্প, নকল সিনেমা- এসব কারণে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিল। ঠিক এই সময় যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। হঠাৎ বাংলা সিনেমা শরীরনির্ভর হয়ে গেল। যতটা না কাহিনি, তার থেকেও বেশি সিনেমার বিভিন্ন পর্যায়ে গানে রগরগে সব দৃশ্য। দর্শককে হলে ধরে রাখতে সিনেমা জগতে নোংরা পরিবর্তন আনা হলো। কাহিনির বালাই নেই, সিনেমায় ঢুকে গেল অশ্লীলতা। এতে প্রথমে একশ্রেণির দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়লেও এই শ্রেণির দর্শক আর পরিবার নিয়ে দেখার দর্শক এক নয়। দর্শকদের বিরাট একটা শ্রেণি সিনেমা হল থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি বহুদিন দেখেছি স্কুল-কলেজগামী ছেলের দল হা করে সেসব পোস্টার দেখছে। আমাদের সংস্কৃতির যা বারোটা বাজার, ততদিনে বেজে গেল। খুব পরিকল্পিতভাবে দেশে বহু দিন ধরে চলে আসা সংস্কৃতিটা শেষ করে দেওয়া হলো।

সিনেমা হলগুলো দর্শকশূন্য হয়ে গেল। হল মালিকরা প্রমাদ গুনলেন। তারা সিনেমা হল বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিলেন। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল। সেসব এখন সুসজ্জিত মার্কেট বা ভাড়া দেওয়া বাড়ি। এই যে আমাদের সংস্কৃতিকে একেবারে সুপরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দেওয়া হলো, তার দায় কার? কেউ কি কখনো এর কারণ খুঁজে দেখেছেন? এখান থেকে আমরা বড় একটি শিক্ষা পেলাম। তা হলো মানুষকে নোংরামি দিয়ে বেশিদিন মুগ্ধ করে রাখা যায় না। মুগ্ধ রাখতে হলে সৃষ্টিশীল কাজের প্রয়োজন। সিনেমা হল বন্ধের জন্য কেবল নগ্নতাকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তবে এটি প্রধান একটি কারণ। দেশে আজ অনেক টিভি চ্যানেল। প্রতিটি চ্যানেলেই সিনেমা প্রচারিত হচ্ছে। তাই দর্শকরা সিনেমা হলে যেতে কিছুটা আগ্রহ হারিয়েছেন। যেখানে আগে সিনেমা হলগুলোই ছিল অনেক ব্যস্ততার মধ্যে বিনোদনের অন্যতম বড় একটি উপায়, সেখানে আজ বাড়িতে বসেই টিভিতে সিনেমা দেখা যাচ্ছে। তবে এ কারণটি বেশি শক্তিশালী নয়। আমাদের পাশের দেশেও চ্যানেলের সংখ্যা কম নয়। তেমনি সিনেমা হলের সংখ্যাও অনেক বেশি। আবার প্রতিটি নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে দর্শক হুমড়ি খেয়ে ছুটে যায় সিনেমা দেখতে। আজ অনেক উপজেলা পর্যায়ে বড় হয়ে ওঠা সন্তান জানে না সিনেমা হল আসলে কী। বড়পর্দায় সিনেমা দেখার মজা কেমন? কারণ তারা নাম শুনলেও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি। কেননা অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে কোনোদিন সিনেমা দেখতে যাননি।

প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ, তারেক মাসুদসহ অনেক খ্যাতিমান পরিচালক উল্লেখযোগ্য ভালো সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এখনো কিন্তু ভালো ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তবে তার খোঁজ মফস্বল অঞ্চলের মানুষ কমই জানে। কারণ বাড়ির টেলিভিশনগুলোতেও বাংলার চেয়ে বিদেশি চ্যানেল দেখার প্রতি আগ্রহ বেশি। তবে সেগুলো হলের আগের অবস্থা ফেরাতে পারেনি। তার প্রধান কারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা। দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষের যে স্থায়ী বিতৃষ্ণা জন্মেছে তা ঠিক কবে কাটবে বলা যায় না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads