• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার পথনকশা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার পথনকশা

  • প্রকাশিত ২৮ মার্চ ২০১৯

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশ হতো না, যদি তারা আমাদের শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত না করত। দীর্ঘদিন শোষিত হওয়ার পর বাঙালি জনসাধারণ সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়েছে। অতঃপর স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেরণা থেকে দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক আচরণকে ধূলিসাৎ করে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভাঙন ও নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং নিজেদের কৃতকর্মের দ্বারা নব্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকেই দেখা যায়, মোট আয়ের ৭০-৮০ (প্রায়) ভাগই সামরিক খাতে ব্যয় হতো। সেনাবাহিনীতে অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি থাকার কারণে তারাই এ সুবিধা ভোগ করত এবং সরকারের প্রতি অনুগত হতো। ১৯৫৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তান ১.৫%, নৌবাহিনীতে ১.২% ও বিমানবাহিনীতে ৪.৬% অফিসার পদে নিযুক্ত ছিলেন। বাদবাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানি। একই বছর সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৯ জন সচিব থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কারো পক্ষে সচিব হওয়ার সৌভাগ্য জোটেনি। বেসামরিক আমলাদের মধ্যে শতকরা ৭ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের, বাকি ৯৩ ভাগ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিয়ে গেলেও পূর্ববঙ্গ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা পায়নি। তাদের স্বাধীনতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে সীমাবদ্ধ। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বৈষম্য, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা থেকে রক্ষায় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ মিলে ধর্মের ভিত্তিতে এক মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করলেও সত্যিকার অর্থে বৈষম্য ও আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারেনি পূর্ববাংলার জনগণ।

বাঙালি জাতিকে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করার জন্য শিক্ষা সংকোচন ও দুই পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্যমূলক আগ্রাসনের নীতিমালা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কার্যকর করা হয়। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৪১৩টি। পক্ষান্তরে পূর্ববঙ্গে ছিল ২৯ হাজার ৬৬৩টি। কিন্তু ১৯৬৯ সালে দেখা যায় পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩ হাজার ৯৪১টি বৃদ্ধি পেলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা হ্রাস পেয়ে ২৮ হাজার ৩০৮টিতে পরিণত হয়। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ৫টির বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় ২টি এবং মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে মাত্র ১টি করে। ফলে (’৫১-৫২) অর্থবছরে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ৮৬.৬% আর পূর্বে মাত্র ১২%। উভয়ের মধ্যে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের আনুপাতিক হার দাঁড়ায় ৪:১।

পূর্ববঙ্গের অর্থনীতি সবসময় কৃষিনির্ভর ছিল। পশ্চিমাদের বৈষম্যের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পায়নি এ অঞ্চলের কৃষি খাত ও জনসাধারণ। সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বার্ষিক ২১.৬৩ লাখ টাকা ব্যয় করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খরচ করে মাত্র ১.৩৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া কৃষিঋণের জন্য দেয় অর্থের সিংহভাগ (৮৩.৯%) পেত পশ্চিমা কৃষকরা। নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্যের আনুপাতিক বৈষম্যের হার প্রায় ২:১। পশ্চিম পাকিস্তানের চাল ও আটা মণপ্রতি ২৫ ও ১৫ টাকা হলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা দ্বিগুণ করে যথাক্রমে ৫০ ও ৩০ টাকায় বিক্রি করত, যা জনসাধারণের ক্রয়ে কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে পূর্ববঙ্গের লোকায়ত স্তরের জন-জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তাই তারা পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করতে না পারলেও তাদের সৃজিত লোকসাহিত্যের মধ্য দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে পাক-শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনগণকে অবহিত করেন।

শাসকশ্রেণি শোষিতদের শোষণ করতে থাকবে এবং একসময় শোষিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে ও সংগ্রামে লিপ্ত হবে। উভয়ের মধ্যে সংগ্রাম চলতে থাকবে এবং একপর্যায়ে শাসকগোষ্ঠীর উৎখাত ঘটিয়ে শোষিতরা বিজয়ের মধ্য দিয়ে এক নতুন সমাজ গড়ে তুলবে। এখানেও শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতাযন্ত্র ব্যবহার করে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ওপর শোষণ চালাতে লাগলেন। শোষিত হওয়ার একপর্যায়ে পূর্ববঙ্গের লোকায়ত স্তরের জনগণ লোকসাহিত্য সৃষ্টি করে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ ও তাকে ‘রক্তচোষা’ নামে ন্যক্কারজনক অভিধায়  ভূষিত করে। অতঃপর শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে হতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অধিকার-সচেতন হয়ে ন্যায্য অধিকারের দাবিতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আগ্রাসনের থাবানল থেকে মুক্তির অভিপ্রায়ে ’৬৬-র ছয় দফা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ’৬৯-এর এগারো দফা, গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি, যার পরিণতিতে বাংলাদেশের দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে লাল-সবুজবেষ্টিত ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটায়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম বছরের বাজেট (১৯৪৭-৪৮) ঘোষণায় দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মোট বাজেটের ৭৫% বরাদ্দ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট মাত্র ২৫%। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪% জনগোষ্ঠীর জন্য ৩১৮ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাগ্যে জোটে মাত্র ৪০ মিলিয়ন টাকা। কিন্তু রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। এভাবে বাজেট থেকে শুরু করে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, নিত্যপণ্যের দাম ও কর নির্ধারণ- সব ক্ষেত্রেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য পরিলক্ষিত। রাজনীতির ক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গের রাজনীতিবিদদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। মন্ত্রিসভায় ১৪ জন মন্ত্রীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র ৪ জন মন্ত্রী হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পদমর্যাদায়ও এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের উপযুক্ত পদ থেকে বঞ্চিত করা হতো।

এভাবে সময়ের পালানুক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের কাছে এক নব্য উপনিবেশবাদী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সদ্যগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশলগ্ন থেকে শুরু হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য। প্রথমেই শুরু হয় ভাষার প্রতি বৈষম্যমূলক আগ্রাসন। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ৫৬% জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতাযন্ত্র ব্যবহার করে তাদের ৭.২% জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ ও আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছে। শুরু হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের রক্তিম এক ইতিহাস। অবশেষে ৬ জন শহীদের রক্তের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে ১৯৫২ সালে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বাহন বাংলা ভাষার অধিকার ফিরে পায়। স্বাধীন বাংলার অধিকাংশ রাজনীতিবিদই ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে সদাব্যস্ত। ক্ষুদ্রতর ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর স্বার্থ রাষ্ট্র ও এর জনগণের জন্য ভাবার অবকাশ পাচ্ছেন না। নির্বাচনের চাঁদরজনীতে নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে অগনিত মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে পুতুল খেলা খেলছেন। জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, আবেগ নিয়ে বার বার প্রতারিত করা হচ্ছে। ক্ষমতায় এসে প্রতিটি সেক্টরকে দলীয়করণ করা এক শৈল্পিকতায় রূপ নিচ্ছে। স্থায়িত্ব ও টেকসইহীন উন্নয়নের ফলে ফাউন্ডেশনহীন ভবনের যে দশা, বাংলার উন্নয়নেরও সমদশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পকে অন্য সরকার এসে প্রতিহিংসাপরায়ণতায় মৃত্যুমুখে ধাবিত করছে।

নানাবিধ সমস্যা, বৈষম্য ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির খপ্পরে পড়ে তৎকালীন পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের মধ্যেও ভাঙন ধরছে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ বাংলাদেশের বাঙালি জাতিসত্তার ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে আছে অথচ চারদিকের শত্রুরা এ দেশকে গ্রাস করার কুচক্রে লিপ্ত। প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পথে, যদিও আমরা গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন ও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক দলাদলি-হানাহানি, দ্বেষ-বিদ্বেষ ও হিংসানলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছি। তাই আমাদের উচিত দেরি না করে ক্ষুদ্রতর ব্যক্তিস্বার্থ পরিহার করে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সহযোগিতা, সুহূদ্যতা, সহনশীলতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বহিঃশত্রুকে ধূলিসাৎ করে জনসাধারণ যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই স্বপ্নকে ফিরে এনে ও স্বাধীনতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে এ দেশকে অগ্রসরমান হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অন্যথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতবর্ষ, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার পর ‘হায় বাংলাদেশ, হায় বাংলাদেশ’ বলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ক্রন্দনের আহাজারি অতঃপর অশ্রুসিক্ত জলে নদী ভরাট করলেও লাভ হবে না। যা করার এখনই করতে হবে।

 

কাজী জহিরুল ইসলাম

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads