• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন হলে দুর্ঘটনার ঝু‍ঁকি কমবে

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন হলে দুর্ঘটনার ঝু‍ঁকি কমবে

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ২২ এপ্রিল ২০১৯

অগ্নি-দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না রাজধানী ঢাকার। মাত্র ৩৭ দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় ঘটল আরেকটি বিভীষিকাময় আগ্নিকাণ্ড। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে আকাশচুম্বী ফারুক রূপায়ণ (এফআর) টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড আবার কেড়ে নিল এক বিদেশি নাগরিকসহ ২৫ জনের জীবন। অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছেন আরো ৭০ জন। হতভাগাদের কারো মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে, কারো মৃত্যু হয়েছে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। আবার কারো মৃত্যু হয়েছে বাঁচার জন্য ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে।

দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। অগ্নি-দুর্ঘটনাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়ে ভবন মালিকদের ও ব্যবসায়ীদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বনানীর অগ্নিদগ্ধ ভবনটির মালিক ১৮-তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩-তলা নির্মাণ করেন। একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে যেভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা পুরোপুরি ছিল না এফআর টাওয়ারে। তবে দু-একটি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ছিল অকেজো। ভবনটিতে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং জরুরি সিঁড়ি থাকত, তা হলে এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। গত জানুয়ারি মাসেও এই ভবন কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি। শুধু এফআর টাওয়ারই নয়, ঢাকা মহানগরীর অন্তত ১১ হাজার বহুতল ভবন এখন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ সংক্রান্ত সুপারিশ যারা বাস্তবায়ন করেনি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। মনে হয়েছে এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহিদুল্লা বলেছেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে বিল্ডিং করা হয়নি। একই সঙ্গে আবার ফায়ার ডোরও ছিল না। এসব কারণেই অগ্নিকাণ্ডে এমন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বিএনবিসি কোড অনুযায়ী হাইরাইজ বিল্ডিং বানানোর ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচতলার উপরে একটি করে নিরাপদ এলাকা করা হলে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে হতো না। কেউ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতেন না। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল সহজেই উদ্ধার করতে পারত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিটি উঁচু ভবনে প্রতি পাঁচতলার উপরে নিরাপদ এলাকা থাকে। ভবনে আগুন লাগলে ভবনের বাসিন্দারা ওই এরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে আগুন তো দূরের কথা, ধোঁয়াও প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মানুষ মারা যায় না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৯০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন। এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। শুধু ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১৩০ জনের। ২০১৮ সালে কেবল ঢাকা বিভাগেই ৬ হাজার ২০৮টি অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটে।

কোনো বিল্ডিংকে যে কোনো ঝুঁকি সহনীয় করে গড়ে তুলতে বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ করা হয়। ১৯৯৩ সালে হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়, যা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ২০০৬ সালে আইনগত ভিত্তি পায়।  কিন্তু বিল্ডিং কোড প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অদ্যাবধি কোনো প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। বড় বড়  শহরের পাশাপাশি উপজেলা শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে এখন উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে। অথচ ছোট শহর তো দূরের কথা, রাজধানী ঢাকা শহরেই বিল্ডিং কোডের নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না।

জাতীয় বিল্ডিং কোড তথা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হচ্ছে, ৭-তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর চেয়ে উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেক্টর, উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নগরীর বেশিরভাগ ভবন নির্মাণে এসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।

২০০৬ সালে ফিনিক্স ভবন ধসের পর তৎকালীন সংসদে একটি আইন পাস হয়েছিল। ওই আইনে বলা আছে, যদি কেউ জাতীয় বিল্ডিং কোডের অংশবিশেষও সঠিকভাবে মানতে ব্যর্থ হন, তা হলে তিনি কমপক্ষে সাত বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এমন একটি কঠিন আইন প্রণয়নের ১২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও রাজধানীতে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটা বাঞ্ছনীয় নয়। বিল্ডিং কোড হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশন জাতীয় বিল্ডিং কোড হালনাগাদের খসড়া তৈরি করে। কিন্তু এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। হালনাগদ কোডের খসড়ায় ৫ সদস্যের একটি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রতিটি বহুতল ভবনের ছাদে ফলমূল, শাকসবজি ও ঔষধি গাছের বাগান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং সোলার প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করে জাতীয় বিল্ডিং কোড সংশোধন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। নগরের বিভিন্ন সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতাও জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের অন্তরায়। বিদেশে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মেয়রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রয়োজনে দেশের সব নগরে একধরনের নগর সরকার গঠন করে নগরের সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগর সরকারের একক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক দুই ধরনের ভবন নির্মাণেই আগুন নেভানোর সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় অগ্নিনিরাপত্তা ও অগ্নিব্যবস্থাপনা। বহুতল ভবনে এসব ব্যবস্থা ছাড়া ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে বিল্ডিং কোড না মেনেই এবং উন্নত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই বছরের পর বছর কীভাবে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। সুতরাং উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশেও অনুরূপ অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কাগজে-কলমে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ করছি স্লোগান তুলে আখেরে দেশ ও জাতির ভরাডুবি ছাড়া কার্যত কিছুই হবে না।

যদিও আমরা জানি যে, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে ২০০৩ সালে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে সরকার। এই আইন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। মূলত ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নি-নিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কিনা— এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্র দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপরই এই ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজউক থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এরপর ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ আংশিক বা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউকের কাছ থেকে বসবাস বা ব্যবহারের সনদ নিতে হয়। এই সনদ দেওয়ার সময় নকশা অনুযায়ী ভবনটি নির্মিত হয়েছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ দৃশ্যমান নয়। এজন্য জাতীয় নির্মাণবিধি অমান্য করেই ঢাকা মহানগরীতে গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো বহুতল ভবন নামের মৃত্যুকূপ।

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ময়মনসিংহের মতো বিভাগীয় শহরেও গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। এসব ভবনে কতটুকু ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থা আছে তা আমাদের জানা নেই। তবে বনানীর মতো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি ঢাকার চেয়েও যে ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ঢাকাসহ দেশের সব নগরে বিল্ডিং কোডের নিয়মকানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করেই যাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়, তা নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় এসব দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। খোলা নেই ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের স্বপ্ন পূরণের পথ।

 

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, গোপালপুর , নাটোর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads