• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিকতার দায়

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিকতার দায়

  • শরীফুর রহমান আদিল
  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৯

এ মাসের শুরুতে তথা ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক কলঙ্কযুক্ত ইতিহাস রচিত হলো। এ কলঙ্কের শুরু অধ্যক্ষ কর্তৃক ছাত্রীর যৌন নিপীড়ন দিয়ে আর শেষ তাকে পুড়িয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে।  এই পাশবিক হত্যাকাণ্ড দেশবাসীর মনে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিনিয়ত অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে চলছে বিক্ষোভ, মিছিল, সভা-সমাবেশসহ মানববন্ধন। এসব বিক্ষোভ ও মানববন্ধন থেকে কেবল অধ্যক্ষ সিরাজ ও তার দোসরদের বিচার দাবি করা হচ্ছে না; বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তারও নিশ্চয়তা চাওয়া হচ্ছে।

আমরা স্পষ্টই বলতে পারি যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু সেকেলে নিয়ম-নীতি সিরাজসহ শামীমদের এসব কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। যেমন— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা পরিচালনা পর্ষদ আইন এবং নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কেন্দ্র স্থাপন করে নিজস্ব কেন্দ্রসচিবসহ কেন্দ্র পরিচালনা কমিটি করার অপরিপক্ব বিধিটি নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য সিরাজ গংদের পুরোপুরি সহায়তা করেছে। অর্থাৎ এ জঘন্যতম ঘটনাটির জন্য সিরাজসহ তার গংদের যত দোষ, তার চাইতেও ঢেরগুণ বেশি দোষ আমাদের অপরিপক্ব শিক্ষা ব্যবস্থাপনার। কেননা আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার প্রায় ৯৪ শতাংশই এমপিওভুক্ত। আর এ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কিংবা দেখভালের দায়িত্ব থাকে পরিচালনা পর্ষদ নামে একটি গোষ্ঠীর কাছে। এ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি থেকে শুরু করে সদস্য সবাই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা হয়ে থাকেন।  আর এসব পরিচালনা পর্ষদ অধ্যক্ষকে তাদের অনুগত বানিয়ে কিংবা চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে তাকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরো শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তাদের শিক্ষা দফতর, যেখানে অধ্যক্ষ এ দফতরের সেক্রেটারি, ছাত্ররা তাদের সাধারণ কর্মী এবং ছাত্রীরা তাদের মনোরঞ্জনের বস্তু! সুতরাং তারা তাদের অনুগত অধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষককে যা বলবেন, তারা কেবল তা-ই করবেন। এবং অধ্যক্ষও যা করতে চাইবেন, পরিচালনা পর্ষদও তা-ই করতে অনুমতি দেবে, যদি তা সাত খুন হয় তবুও ক্ষমার নিশ্চয়তা। এই যদি হয় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ইতিবৃত্ত, তাহলে আমাদের দেশে সিরাজের মতো লোকদের এহেন কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক কিংবা হতাশ করার মতো কি?

আগে থেকেই শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার দরুন ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। কেননা পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ যে কোনো ধরাকে সরাজ্ঞান করতে পারে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে কোনো আইন পরিবর্তন করতে পারে। যে কোনো অবৈধকে বৈধ ও বৈধকে অবৈধ করতে পারে; সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ইচ্ছামতো খরচের বৈধতা রয়েছে। আর এই পরিচালনা পর্ষদকে হাতে রেখে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা যে কোনো অনৈতিক কিংবা অপরাধমূলক কাজ করেও ছাড় পেয়ে যাওয়ার বহু নজির আছে।  একইভাবে দলীয় পরিচয় কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অধ্যক্ষকে বাধ্য করা হয় তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। তারই প্রমাণ— দেশের বিভিন্ন স্থানে এমপি, মন্ত্রী, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা কিংবা চেয়ারম্যানের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ফুল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা খরচ করে এসব নেতার সংবর্ধনার আয়োজন করা কিংবা এসব স্থানীয় নেতার মনোরঞ্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে নাচ-গান করানো অথবা মিছিল সমাবেশে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা এবং দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা এখন ওপেন সিক্রেট। এসব ঘটনা কখনো কখনো আমাদের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এসব কর্মকাণ্ড কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা করেননি বরং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা শিক্ষকরাই করেছেন। কারণ এসব শিক্ষকের চাকরি ওই নেতাদের হাতে। সুতরাং এসব নেতাকে যত বেশি খুশি করা যাবে, তার কিংবা তাদের চাকরি তত বেশি স্থায়ী হবে; সঙ্গে যে কোনো অনৈতিক কাজ করে ছাড় পাওয়ার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে।

সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ সরকারিভাবে হলেও চাকরি থেকে বহিষ্কার করার দায়িত্ব কিন্তু এখনো পরিচালনা পর্ষদের হাতেই রয়ে গেছে। ফলে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানপ্রধান নৈতিকতা সম্পন্ন থাকলেও চাকরি হারানোর ভয়ে তারাও এসব নেতার যে কোনো যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক দাবি মানতে বাধ্য হন। নুসরাত হত্যার বিষয় থেকে অনুমান করা যায় যে, সারা দেশের শিক্ষকরা পরিচালনা পর্ষদ ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে কীভাবে জিম্মি? পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সম্পর্ক কেমন এবং প্রতিষ্ঠানের টাকা ইচ্ছামতো কীভাবে খরচ করে পুরো প্রশাসনকে বশে আনা যায়, তা নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে সোনাগাজী উপজেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কাউন্সিলর, থানার ওসি প্রমুখের সম্পৃক্ততা ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানে এতজন শিক্ষক-কর্মচারী থাকলেও কোনো শিক্ষক কেন সিরাজের এহেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেন না এ প্রশ্ন আসাটা যেমন অস্বাভাবিক নয়, তেমনি চাকরি হারানোর ভয়ে বাকি শিক্ষকদের মুখ বুজে সহ্য করাটাও অমূলক নয়।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের লেজুড়বৃত্তির সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত! এক সময়ের সবচাইতে শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষকসমাজ আজ পরিচালনা পর্ষদের কাছে চাকরি হারানোর ভয়ে সব থেকে অবহেলিত ও নিরীহ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এখনই সময় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে এই অদ্ভুত ব্যবস্থাপনার বিলুপ্তি ঘটানো। জাতীয়করণে সময় লাগলে সেক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ আইনটি বাতিল করে সরকারি কলেজগুলোর আদলে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড আরো একটি বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষাব্যবস্থা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে, নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কেন্দ্রের ব্যবস্থা করে আবার সেই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ কেন্দ্র কমিটি গঠিত হয় ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষকদের দিয়ে! ফলে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন কিংবা অনৈতিক সহযোগিতা করে শিক্ষার্থীদের পাস করানোর হাজার নজির সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে পরীক্ষার কেন্দ্রে একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সদস্য হওয়ায় তারা পরীক্ষার শুরুর ৪০ মিনিট ক্ষেত্রবিশেষে দুই ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র হাতে পায় আর এ সুযোগে নুসরাতকে অধ্যক্ষ সিরাজ কর্তৃক অনৈতিক কাজে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং এর বিনিময়ে বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহের প্রলোভন দেওয়া হয়!

সুতরাং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই উল্লিখিত বিধিসমূহ পরিবর্তন করতে হবে। যদিও আগামীতে প্রতি উপজেলায় স্বতন্ত্র পরীক্ষা ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের কিন্তু তার আগে বর্তমানে প্রচলিত পরীক্ষাকেন্দ্র বিধি পরিবর্তন করে ভিন্নভাবে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য গঠিত পরিচালনা পর্ষদ বিধিটি একেবারে পরিবর্তন করে সেখানে ডিসি, এডিসি, ইউএনও, বিচারক থেকে একজনকে নয় বরং চারজনকেই সম্পৃক্ত করে পরিচালনা পর্ষদ বিধি পরিবর্তন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের সুযোগ ঘটবে এবং শিক্ষকরাও তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত হবেন।

 

লেখক : শিক্ষাবিষয়ক গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads