• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
কংগ্রেস নাকি বিজেপি

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

কংগ্রেস নাকি বিজেপি

  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০১৯

পরশমনি তালুকদার ও জুবায়দা আফরোজ বাবলী

 

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, যার ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে ১১ এপ্রিল থেকে। চলবে ১৯ মে পর্যন্ত। বরাবরই ভারতের এই লোকসভা নির্বাচন বিশ্ববাসীর অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কেননা এই নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করবে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারতবর্ষের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ভারত ও নেহরুর নিরপেক্ষ ভারত ক্রমেই মোদির উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতে পরিণত হবে, নাকি অসাম্প্রদায়িক ও সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্র চর্চা হবে? সম্প্রতি ভারতের রাজনীতি ও নির্বাচনের এসব বিচার-বিশ্লেষণ এবং হিসাব-নিকাশ ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি তথা এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। বলা হয়ে থাকে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এই নরেন্দ্র মোদি গুজরাট রাজ্যকে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব তথা বিনিয়োগের অন্যতম স্থান এবং উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেন; যার প্রেক্ষিতে বিজেপির রাজনীতি তথা সর্বভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী নেতা হিসেবে তার উত্থান। ২০১৪ সালে তিনি ভারতব্যাপী সৃষ্টি করেছিলেন মোদি-জোয়ার। তারপর সেই মোদি-জোয়ার ক্ষমতাসীন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের দুর্গে আঘাত হানে এবং ব্যাপকভাবে পরাজয় বরণ করে ১৩৪ বছরের পুরনো এই রাজনৈতিক দলটি। লোকসভা নির্বাচনে তারা মাত্র চল্লিশটি আসন লাভ করে। ভারতের রাজনীতিতে মোদির উত্থান অনেকটা রূপকথার মতো। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।

নিজেকে প্রধানমন্ত্রী নয়; বরং জাতির চৌকিদার দাবি করেই তিনি ক্ষমতায় আসেন। বর্তমানে তার অবস্থান বুঝতে হলে বিগত সময়ে বিজেপির শাসন ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা জরুরি। ২০১৪ সালে গুজরাট মডেল অনুসরণ করে আর তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতিতে ত্যক্ত-বিরক্ত ভারতের জনগণ অনেকটা আশান্বিত হয়ে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। শক্তিশালী ভারত গঠন তথা ভারতীয়দের ভাগ্য উন্নয়নের যে দায়িত্ব ভারতবাসী বিজেপি সরকার ও নরেন্দ্র মোদিকে দিয়েছিল তা তারা ভালোভাবে পালন করেছে বলে মনে হয় না। কারণ গত পাঁচ বছরে ভারতের বেকারত্ব বৃদ্ধি, কৃষকদের আত্মহত্যা, বিতর্কিত আইন প্রণয়ন, রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেলেংকারির মতো দুর্নীতি বিজেপি সরকারের অবস্থা শোচনীয় করার পাশাপাশি মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নির্বাচন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ভারতের দ্যা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে জরিপ বলছে, ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারতে বেকারত্ব বেড়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, বিগত ৪৫ বছরে যা রেকর্ড। মোদি সরকারের আমলে কৃষিঋণ ও ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া আসামের নাগরিক সংশোধনী বিল ভারতে বিভক্তির রাজনীতি আরো বেশি মাথাচাড়া দিতে সাহায্য করেছে। রক্ষণশীল রাজ্য কেরালার শবরিমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকারের জন্য যে পদক্ষেপ মোদি সরকার নিয়েছে, তাতে কেরালায় বিজেপির অবস্থান আরো নাজুক করবে বলে অনেকেই মনে করেন।

ভারতের এ নির্বাচন মোদির জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তার ইশতেহারের কিছু বিতর্কিত সংকল্পনামা। ভারতের সংবিধানের ৩৫ নং ধারায় উল্লেখিত কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার আইন বাতিলে মোদির ঘোষণা। কাশ্মির অধিকার আইন অনুযায়ী কাশ্মিরের স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া অন্য কারোর জমি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা, যেটাকে উন্নয়নের বাধা হিসেবে উল্লেখ করে এ আইন বাতিলের পরিকল্পনা নিয়েছে মোদি সরকার।

এখানে নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের কথা বললেও এর অন্তরালে রয়েছে শিল্পপতিদের স্বার্থ। এই ইশতেহারই প্রমাণ করেছে মোদি আসলে কাদের চৌকিদার- জনগণের, নাকি মমতা ও রাহুলের বলা সেই শিল্পপতিদের। বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ মোদির ইশতেহারের আরেকটি বিতর্কিত ইস্যু যা গোঁড়া হিন্দুত্ববাদকে সমর্থন করে। সংকল্পপত্রের এ বিষয়টি নিরপেক্ষ ভারতের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্ন থেকেই যায় মোদি আসলে কাদের চৌকিদার- হিন্দুত্ববাদের, নাকি সর্বভারতীয় জনগণের? চলমান লোকসভা নির্বাচনে মোদির ইশতেহারের এসব বিতর্কিত ইস্যু এবং বিগত পাঁচ বছরে বিজেপি সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক প্রভাবকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে মাহরাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যগুলোতে গত নির্বাচনের ফলাফলকে ধরে রাখা। উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে যদি বিজেপি তাদের আগের অবস্থান ধরে রাখতে না পারে, তাহলে ভোটের সমীকরণ উল্টো হতে পারে। এদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ও আম আদমি পার্টির অরবিন্দু কেজরিওয়াল ভোটের আগে-পরে যুক্ত হলেও গঠন হতে পারে বিকল্প সরকার।

নির্বাচনের আগের জনমত জরিপগুলো বলছে, বিজেপি আরো পাঁচ বছর শাসনক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট পাবে। রাজনৈতিক বোদ্ধা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, হয়তো ২০১৪ সালের সেই মোদি-ম্যাজিক বা মোদি-জোয়ার কিছুটা কমে গেছে; কিন্তু বিকল্প কেউ তার দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনী লড়াই বিজেপির মোদি বনাম কংগ্রেসের রাহুল মনে হলেও সমালোচকরা বলছেন, মোদির বিপরীতে একক নেতা হিসেবে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী নিজেকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।

বিজেপি যেভাবে মোদিকে আবারো প্রধানমন্ত্রী বানাতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে, সেদিক থেকে পিছিয়ে আছে কংগ্রেস। কংগ্রেস জিতলে রাহুল গান্ধীই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এমনকি এক্ষেত্রে কংগ্রেস ভারতের জনগণকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে। রাহুল গান্ধী মোদির বিরুদ্ধে রাফায়েল কেলেংকারি এনে হয়তো মোদিকে কিছুটা বিপাকে ফেলেছেন, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে মোদিকে ধরাশায়ী করতে পারেননি। তবে চলমান লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে দিল্লির গদিতে কে বসবেন তা এখনো বলা কঠিন।

 

লেখকদ্বয় : স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads