• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
 দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির নিয়ন্ত্রণ জরুরি

ছবি :সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির নিয়ন্ত্রণ জরুরি

  • প্রকাশিত ২১ মে ২০১৯

নাজমুল হক

 

চলমান রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে যা সাধারণ ভোক্তাদের নাগাল অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট পণ্য মজুত করে আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে যার দরুণ প্রতিটি দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে প্রভাব সৃষ্টি করেছে। আর রীতিমতো দুঃখ-দুর্দশা পোহাতে হচ্ছে এদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের। স্বভাবতই অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়, আর এই সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায় না এদেশের স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এতে করে দিশেহারা মানুষদের বাধ্য হয়েই চড়া দামে কিনতে হচ্ছে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।

আয় না বাড়লেও, অকস্মাৎ বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম। আর এটি যেন সাধারণ মানুষদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এ পরিস্থিতি যে শুধু এ বছরই পোহাতে হচ্ছে এমনটি নয়; বরং এটা যেন প্রতি বছরের অভ্যাসে পরিণত হয়ে আসছে। এজন্য সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে। আর এসব সাধারণ মানুষ মেনেই নিয়েছে যে এটি পরিবর্তন করার সাধ্য তাদের নেই। তাদের মতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, এটা স্বাভাবিক; তবে এত বেশি বৃদ্ধি পাওয়া সমীচীন নয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম কমিয়ে স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করে। এক্ষেত্রে যেহেতু চাহিদা বাড়ে, তাই বেশি বিক্রি হওয়ায় মুনাফার পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন— মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে দাম কমিয়ে এনে ভোক্তাদের মধ্যে বেশি পণ্য বিক্রি করে। কিন্তু বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম ঘটে। এই দেশে রমজান মাস এলেই ব্যবসায়ীরা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করে দ্রব্যমূল্যের দাম ইচ্ছামাফিক বাড়িয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে। তবে সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তা কিন্তু নয় বরং যেগুলোর বাড়তি চাহিদা রয়েছে সেগুলোর মূল্যে তফাত লক্ষণীয়।

মূলত যে কয়েকটি কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকা। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের একটি অংশের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাব দায়ী। কখনো চাহিদা বেড়েছে, কখনো সরবরাহ নেই— এরকম নানা অজুহাত দেখিয়ে কৌশল অবলম্বন করে থাকে তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামের ওঠানামার ভিত্তিতে দেশের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু সংশয়ের বিষয় হলো, চলতি সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি না পেয়ে তুলনামূলকভাবে কমেছে, তবু দেশের বাজার অস্বাভাবিক। হিসাব অনুযায়ী, গত মাসে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছিল ৫০-৫৫ টাকা দরে, যা এখন ৬০-৬৫ টাকা অর্থাৎ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে তা কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আগে যে চিনি প্রতি টন ২৯০ মার্কিন ডলার বিক্রি হতো, তা গত মার্চ মাস থেকে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ মার্কিন ডলারে। তবু এদেশে চিনির দাম কমেনি।

পণ্যের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, রমজান মাস এলেই ভোক্তারা অনেক সময় একসঙ্গে বেশি পরিমাণে পণ্য কিনে তা মজুত করার ফলে বাজারের ওপর খানিকটা প্রভাব পড়ে থাকে। এভাবে সারা মাসের বাজার একবারে না করে প্রয়োজনমাফিক প্রতিদিন তা সরবরাহ করলে ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিকভাবে মূল্য বৃদ্ধি করার প্রবণতা কমে যাবে। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে স্বস্তি প্রদান করতে বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, রমজানে ভোজ্য তেলের চাহিদা থাকে আড়াই থেকে ৩ লাখ টন, চিনি ৩ লাখ টন, ছোলা ৮০-৯০ হাজার টন, খেজুর ১৮ হাজার টন এবং পেঁয়াজ ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন এবং মসুর ডাল ৫০-৬০ হাজার টন। এ ছাড়া চাল, গম, আদা ও রসুনও চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। আর এরই মধ্যে এই পণ্যগুলোর পর্যাপ্ত মজুত রাখা হয়েছে। রমজানের আগে থেকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলে আসছে, রমজানে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। অযৌক্তিকভাবে কোনো দাম বাড়ানো যাবে না। কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এখানে আমার প্রশ্ন হলো, এত পণ্য মজুত থাকার পরেও কেন পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ল?

এক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অভিযোগ শোনা যায়, পণ্য পরিবহনের পথে বিভিন্ন ধাপে চাঁদাবাজির কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় যার অর্থনৈতিক প্রভাব চূড়ান্তভাবে গিয়ে পড়ে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। ট্রাফিক পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের বিরুদ্ধেও পণ্যবাহী যানবাহনের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। সরকারকে এগুলো যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরবরাহজনিত ব্যবস্থার মান উন্নত করতে হবে। সর্বোপরি, বাজারকে অসাধু সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্ত করে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা দরকার। এর  মাধ্যমে বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ হবে। আর এক্ষেত্রে সচেতন নাগরিক মহলকেও তৎপর ও মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads