• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ক্রমাগত শেয়ারমূল্য পতন রোধে করণীয়

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

ক্রমাগত শেয়ারমূল্য পতন রোধে করণীয়

  • প্রকাশিত ২৪ মে ২০১৯

মো. আশরাফ হোসেন

 

 

আনুষ্ঠানিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের জন্য মূলত দুই ধরনের অর্থায়ন প্রয়োজন হয়। একটি হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি মূলধন, অন্যটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন। দীর্ঘমেয়াদি মূলধন প্রয়োজন হয় স্থায়ী ব্যয় নির্বাহের জন্য। পক্ষান্তরে স্বল্পমেয়াদি মূলধন প্রয়োজন হয় চলতি মূলধন জোগানোর জন্য। উদ্যোক্তারা সাধারণত প্রাথমিকভাবে স্থায়ী ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থায়ন করে থাকে যা হয় কোম্পানির মেমোরেন্ডামে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে শেয়ার গ্রহণের মাধ্যমে। উদ্যোগের দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা হয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে। উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় অধিক দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহ করে ক্যাপিটাল মার্কেটে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করে থাকেন। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সংগৃহীত হয় প্রধানত উদ্যোক্তা ও ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। অন্যদিকে স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধন সংগৃহীত হয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।

বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেট খুব কার্যকর নয়। উদ্যোক্তারা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহে উৎসাহী নন। আবার সাধারণ মানুষ ক্যাপিটাল মার্কেটকে বিনিয়োগের জন্য ভালো স্থান বিবেচনা করেন না। কারণ তারা ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগ করে উৎসাহব্যঞ্জক লভ্যাংশ পান না। কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগে তারা উৎসাহী নন। বাংলাদেশ অরিজিন লিস্টেড কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানের মন-মানসিকতা ধারণ করেন না। বাংলাদেশ অরিজিন কোম্পানিগুলো যে নিট মুনাফাই অর্জন করুক না কেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তারা কোম্পানির রিজার্ভে রিটেন আর্নিং হিসেবে রাখে এবং অনুল্লেখযোগ্য অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করেন। অথচ বাংলাদেশে ব্যবসা করে এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সাধারণত কোম্পানিগুলো নিট মুনাফার অধিকাংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে এবং অতি নগণ্য অংশ রিটেন আর্নিং হিসেবে রিজার্ভে সংরক্ষণ করে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারমূল্য প্রধানত এ কারণেই অভিহিত মূল্য অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে। একই ক্যাপিটাল মার্কেটে বাংলাদেশ অরিজিন কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য কখনো কখনো বৃদ্ধি পেলেও পরে ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, অর্থবছর ২০১৮ শেষে রংপুর ফাউন্ড্রি শেয়ারপ্রতি টাকা ৪.৩৮ নিট মুনাফা অর্জন করলেও শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারপ্রতি টাকা ২.৩০ লভ্যাংশ বিতরণ করেছে। ওই বছর বিএমআরএস দিনে শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা টাকা ৪.২০ অর্জন করলেও বোনাস শেয়ার দিয়েছে ১০ শতাংশ হারে। বছর শেষ ২০১৮ সময়ের জন্য বাংলাদেশ উইনডসর শেয়ার প্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ১.৩০ কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ করেছে শেয়ারপ্রতি টাকা ০.৫০ হারে। একই বছর পদ্মা অয়েল নিট লাভ করেছে টাকা ২৮.৩৬ পক্ষান্তরে শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ১৩.০০। সামিট পাওয়ার ওই সময়ে শেয়ার প্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৫.০৮ অথচ লভ্যাংশ দিয়েছে শেয়ার প্রতি টাকা ৩.০০। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৩.৫০ কিন্তু লভ্যাংশ বিতরণ করেছে শেয়ারপ্রতি টাকা ১.০০। তিতাস গ্যাস ২০১৮ অর্থ বছর শেষে শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৪.২৮ এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে শেয়ারপ্রতি ২.৫০ হারে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক নিট মুনাফা কছে শেয়ারপ্রতি টাকা ২.৩৭ আর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ১.০০ হারে। আমরা টেকনোলজিস ওই বছর শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ১.৯৬ কিন্তু শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ১.০০ হারে।

বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিপরীত অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলো এমনভাবে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ করে যাতে নিট মুনাফার সর্বোচ্চ অংশ দেয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করা যায়, র্যাকিট ব্যানকিজার বাংলাদেশ ২০১৮ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা অর্জন করেছে টাকা ৫৫.৪০ এবং লভ্যাংশ বিতরণ করেছে টাকা ৭৯.০০ হারে। বার্জার পেইন্ট ওই বছর শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৩৫.৫২ এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে ১০০% বোনাস শেয়ার এবং নগদ টাকা ২০.০০। ম্যারিকো বাংলাদেশ মুনাফা অর্জন করেছে টাকা ৬৫.৮৫ এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ৬০.০০ হারে। হাইডেলবার্গ সিমেন্ট জুন ২০১৮ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি টাকা ১৫.৫৯ হারে মুনাফা করে এবং লভ্যাংশ দিয়েছে শেয়ারপ্রতি টাকা ১৫.০০ হারে। একইভাবে সিঙ্গার বাংলাদেশ উক্ত সময়ে শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা অর্জন করেছে টাকা ১১.৯৬ হারে এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে ৩০০% বোনাস শেয়ার। বস্তুত দেশে বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে কম এবং তারা তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ শেয়ার ক্যাপিটাল মার্কেটে ছেড়েছে। তাই অভিপ্রায় থাকলেও তাদের শেয়ার ক্রয় করা মুশকিল।

বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট চাঙ্গা করে তুলতে হলে বাংলাদেশ অরিজিন কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা সব শেয়ারহোল্ডারকে অর্জিত মুনাফার সর্বোচ্চ অংশ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করেন। বর্তমানে যেসব কোম্পানি স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত রয়েছে, তাদের মুনাফার ওপর সরকার হ্রাসকৃত হারে করপোরেট ট্যাক্স ও আয়কর এমনভাবে ধার্য করতে পারেন যাতে পরিচালকরা সব শেয়ারহোল্ডারকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত হয়। অর্জিত লভ্যাংশের যে অংশ কোনো কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের নগদ প্রদান করেন, তার অর্থের ওপর নিম্ন হারে করপোরেট কর ধার্য করতে হবে। মুনাফার যে অংশ রিটেন আর্নিং হিসেবে রিজার্ভে রাখা হবে সে অর্থের উপর উচ্চ হারে করপোরেট কর ধার্য করতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করা যায় যে, বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে মুনাফার ওপর ২৫% হারে করপোরেট কর ধার্য রয়েছে এবং স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৫% হারে করপোরেট কর ধার্য রয়েছে। এ পদ্ধতি বাংলাদেশ অরিজিন লিস্টেড কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের শেয়ারহোল্ডারদের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য হারে লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করে না। যদি কোনো লিস্টেড কোম্পানির মুনাফার যে অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করা হয়, তার ওপর ২০% হারে করপোরেট কর ধার্য করা হয় এবং যে মুনাফার অংশ রিটেন আর্নিং হিসেবে রিজার্ভে রাখা হয়, তার ওপর ৩০% করপোরেট কর ধার্য করা হয় তা হলে পরিচালকরা অর্জিত মুনাফার উল্লেখযোগ্য অংশ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণে উৎসাহিত হবেন।

বর্তমানে লিস্টেড কোম্পানি থেকে ব্যক্তি কোনো লভ্যাংশ পেলে উৎসে ১০% হারে কর কেটে রাখা হয় (যদি উক্ত ব্যক্তির ১২ ডিজিটের টিআইএন থাকে) অন্যথা ১৫% হারে উৎসে কর কাটা হয়। আবার লিস্টেড কোম্পানি থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ পেলে উৎসে ২৫% হারে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। উক্ত কর কাটার পর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্জিত অর্থ কর প্রদেয় আর বিবেচনা করলে লোকেরা লিস্টেড কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহী হবে। লিস্টেড কোম্পানির লভ্যাংশ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়কর ধার্যের ক্ষেত্রে যোগ করার বিধান রহিত করা প্রয়োজন। এসব নিয়মাবলি ধার্য ও কার্যকর করলে লিস্টেড কোম্পানির পরিচালকরা মুনাফার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের প্রদানে উৎসাহিত হবে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লিস্টেড কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহী হবে। দেশের ক্যাপিটাল মার্কেট চাঙ্গা হবে। উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। এতে এসডিজি অর্জন সহায়ক হবে।

বর্তমানে নিযুক্ত সম্ভাব্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে বিমুখ হয়ে রয়েছেন। উদ্যোক্তারা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহ করতে সুযোগ পাচ্ছেন না। বাণিজ্যিক ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে উৎসাহ নয়। কারণ, তারা স্বল্পমেয়াদি জমা সংগ্রহ করে ব্যাংক পরিচালনা করেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা ভিন্ন ভিন্ন পরামর্শ প্রদান করছেন। তার কোনোটিই প্রত্যাশিত ফলপ্রসূ হচ্ছে না। লিস্টেড কোম্পানির পরিচালকরা যখন যৌক্তিক আচরণ করবেন অর্থাৎ সম্ভাব্য সর্বোচ্চ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করবেন তখন কোটি লোকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় যা বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না তা বিভিন্ন বড় উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজে আসবে। লোকেরা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চার ক্রয়ে বিনিয়োগ করবে। কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিপুল অর্থায়নের উৎস হবে। এতে এসডিজি অর্জন সহায়ক হবে। ফলে লোকেরা তাদের বিনিয়োগ হতে উচ্চ হারে লভ্যাংশ পেলে রাতারাতি তাদের শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট বিক্রি করবে না। খুব প্রয়োজন হলেই কেবল বিক্রি করবে। বিএসইসি কর্তৃক এমন নিয়ম করা প্রয়োজন যেন কোনো লিস্টেড কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের সমান বা বেশি রিটেন আর্নিং জমা থাকলে অর্জিত নিট মুনাফার পুরো অংশই শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করতে হবে। ক্রমাগত শেয়ার মূল্য পতন রোধ করতে হলে শেয়ারহোল্ডারদের আর্থিক হারে মুনাফা প্রদানের বিকল্প নেই।

 

লেখক : পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads