• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শক্তিশালী ও অর্থবোধক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শক্তিশালী ও অর্থবোধক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৭ মার্চ ২০২০

‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি’- কথাটি উচ্চারিত হয়েছিল সমকালীন বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রনায়ক আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের আতঙ্ক কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কণ্ঠে। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ন্যাম’ সম্মেলনে মুখোমুখি হলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এই মন্তব্যটি করেছিলেন কাস্ত্রো। কিউবার নেতার এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও সাহস হিমালয়কে ছাড়িয়ে গেছে। আজ থেকে শত বছর আগে একদা প্রমত্ত মধুমতীর তীর ঘেঁষে ছুঁয়ে যাওয়া টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যে খোকার জন্ম হয়েছিল— সেই শিশুই একদিন ফিদেল কাস্ত্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, সালভেদর আলেন্দে প্রমুখের সঙ্গে একই ইতিহাসের ফ্রেমে বাঁধা পড়েছিল। আজ যদি জাতির পিতা বেঁচে থাকতেন তবে তিনি শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালিদের নেতাই হতেন না, তিনি হতেন বিশ্ববরেণ্য মহান নেতাদের কাতারের প্রথম সারির রাষ্ট্রনায়ক। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড শুধু আমাদেরকেই নেতৃত্বহীন-অভিভাবকহীন করে যায়নি, অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বিশ্ব নেতৃত্বের, মানবসভ্যতার।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির পিতার বর্ণাঢ্য জীবন, হিমালয় পর্বত ও বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরি সদৃশ জীবনকাহিনী আলোচনা না করে একজন কলমপেশা সাংবাদিক হিসেবে আমাকে লিখতে হয় সাংবাদিকতার মহান পেশা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু কী স্বপ্ন দেখেছিলেন, কী চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন আর ‘বঙ্গবন্ধুহীন’ বাংলাদেশে কিছু কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্রকে ঘিরে কী জঘন্য মিথ্যাচার ও তথ্য-সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ঘটনাটি সংঘটিত হয় এই দিনে। মানবসভ্যতার কাঁটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনের সামনে। ঘাতকের কালো মেশিনগানের নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন-সম্ভাবনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা। সপরিবারে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে যে সামরিক স্বৈরাচার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইতিহাস বিকৃত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা এবং জাতির ইতিহাসের চাকা পেছনে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানানো। আত্মপ্রতারণার গিলাফ দিয়ে জাতির আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া ও ছলচাতুরির কফিন দিয়ে জাতির সব গৌরবগাথা ও অহঙ্কারকে দাফন করা। এই লক্ষ্য হাসিলের জন্য একশ্রেণির ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী জড়ো করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় বীরদের চরিত্রহননের মাধ্যমে নির্বাসনে পাঠানো ও কিছু চিহ্নিত খলনায়ককে জাতির ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিষিক্ত করা। কিন্তু যেসব মিথ্যাচার দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা সবার অগোচরেই জাতীয় জীবন থেকে অপসৃত হয়। ইতিহাসে মিথ্যাচারের কোনো স্থান নেই, মিথ্যা দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। তাই খলনায়করা নিজেরাই আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আর জাতীয় বীররা মানুষের হূদয়ে বরণীয়-স্মরণীয় হয়ে রয়েছে স্মৃতিসৌধ হয়ে, শহীদ মিনার হয়ে।

জাতির পিতাকে নিয়ে যেসব তথ্য-সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার। বলা হয়েছিল, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু সরকার নিউজপেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স জারি করে কেবল চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং একই সঙ্গে শত শত সংবাদপত্রসেবীকে বেকার করেছিল। শুধু এখানেই তারা থেমে থাকেননি; স্বাধীনতাবিরোধী যে চক্রটি সংবাদপত্র শিল্প তথা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কুক্ষিগত করে রেখেছিল, তারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৬ জুনকে সংবাদপত্রের ‘কালো দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় লালিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিক সমাজ এই কালো দিবসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বরং বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ সারা দেশে ২১ জুন সাংবাদিক নির্যাতন দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এই দিনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর ইঙ্গিতে পুলিশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের পবিত্র অঙ্গনে ঢুকে এক জঘন্য শ্বেত-সন্ত্রাস কায়েম করে এবং দেড় শতাধিক সাংবাদিককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিকালে সংঘটিত এই বর্বর ঘটনার সাফাই গাইতে গিয়ে মতিন চৌধুরী জাতীয় সংসদের পবিত্র ফ্লোরে দাঁড়িয়ে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছিলেন, রাতের আঁধারে পুলিশ সাংবাদিকদের চিনতে পারেনি, তাই ওভাবে পিটিয়েছে।

নিউজপেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সাংবাদিকদের বেকার করা হয়েছে বিষয়টি এমন সরলীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। এটা কোনোমতেই তৎকালীন সময়ে যা ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ নয়। এটা ডাহা মিথ্যাচার— ট্র্যাভািট অব ট্রুথ। শুধু বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে গিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত এই গোয়েবলিক প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। সংবাদপত্রকে নিয়ে সে সময় যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তা ছিল তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাসের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কমিটমেন্ট শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণের মাধ্যমে বাকশাল নামে একটি জাতীয় প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘উহা ছিল একটি অতীব সাময়িক পদক্ষেপ।’ এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল লুটেরা ও ধনিক-বণিক নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন। এই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ ছিল একটি বাস্তবমুখী অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলা, যা সাধারণ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে।

কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিউজপেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন? এ ব্যাপারে দৈনিক দিনকালের উপ-সম্পাদকীয় পাতায় জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার নিবেদিত সাংবাদিক নেতা এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের এককালীন তথ্য-উপদেষ্টা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘সংবাদপত্রের কালোদিবস : পটভূমি ও ঘটনাপঞ্জি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখার জন্য রিয়াজ ভাইকে ধন্যবাদ। যতদূর সম্ভব লেখক তার নিবন্ধে কোনো প্রকার মিথ্যাচার করেননি। তবে চতুর বণিকের মতো তিনি যা করেছেন, তা হলো সত্য প্রকাশ না করা। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি প্রায় সত্যের কাছাকাছি এসেও শেষপর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। অথচ সত্য লিখলে তার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে করি না। বরং একজন সাংবাদিক হিসেবে জাতির কাছে তার যতটুকু দায়বদ্ধতা আছে তা কিছুটা হলেও পূরণ হতো। কিন্তু বিড়ম্বনা অন্য জায়গায়। রিয়াজ ভাইদের দায়বদ্ধতা অন্য জায়গায়। সেখান থেকে যাতে কোনো প্রকার তিরস্কার শুনতে না হয়, সেটা বিবেচনা করেই রিয়াজ ভাই সব সত্য কথা অকপটে লিখতে পারেননি।

জনাব রিয়াজউদ্দিন এক স্থানে লিখেছেন, ‘এমন সময় আমরা সংবাদপত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা বলেন।’ এরপর রিয়াজ ভাই তার নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু সেদিন জাতিসংঘ ও ইরাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব কথা বলেন, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। কিন্তু সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন সেদিন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল, সাংবাদিকদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা এবং সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পুরোপুরি চেপে গেলেন রিয়াজ ভাই তার নিবন্ধে। তবে আমরা অনেকেই জানি সেদিন কী কী বিষয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রিয়াজ ভাই ছাড়াও সেদিন বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতাদের মধ্যে নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানীসহ অন্য নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা দেশে তোদের (আদর করে বঙ্গবন্ধু এভাবেই সম্বোধন করতেন) মোট সাংবাদিক সংখ্যা কত? নেতারা বলেছিলেন ৭-৮শ’র মতো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের তো কমপক্ষে সারা দেশে ৮-১০ হাজার সাংবাদিক দরকার হবে এবং প্রত্যেক সাংবাদিককে হতে হবে চিত্তবিত্তে, জ্ঞান-গরিমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষিত, মার্জিত, মননশীল ও সুকুমার বৃত্তিতে যারা শ্রেষ্ঠ, তারাই থাকবে এ মহান পেশায়। এ কথা শুনে সাংবাদিক নেতারা আবেগ আপ্লুত চিত্তে বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বললেন, আমি চাই দেশে থাকবে প্রচুরসংখ্যক অর্থবহ সংবাদপত্র। উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ইত্তেফাকে প্রকাশিত দেশ-বিদেশের সংবাদ পড়ে আমার দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না। তোমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে আমার বিশাল বাংলার গাঁও-গেরামের কোনো খবর থাকে না। শোনো, আমি ইতোমধ্যেই তোদের পেশার সিনিয়র লোকদের সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি আমূল বিপ্লব সাধন করতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমার সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো হবে—

এক. দেশে নির্দিষ্টসংখ্যক জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা ও ইরেজিতে। এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা, যাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতি পাবে সঠিক পথনির্দেশ। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এসব জাতীয় পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকরাই হবে সবচেয়ে বেশি বেতনের পেশাজীবী, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে থাকবে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার।

দুই. প্রতিটি পেশার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেমন শ্রমিকদের জন্য শ্রমবার্তা, কৃষকদের জন্য কৃষিবার্তা, মহিলাদের জন্য মহিলাবার্তা, যুবকদের জন্য যুববার্তা, ছাত্রদের জন্য ছাত্রবার্তা, শিশুদের জন্য শিশুবার্তা প্রভৃতি। এসব পত্রিকায় সংক্ষেপে জাতীয় বিশ্ব সংবাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশার সব ধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোচনা থাকবে।

তিন. তোরা জানিস সংবাদ হলো পচনশীল দ্রব্য। গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে সংঘটিত সংবাদ শহর-বন্দর পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে আসতে পচন ধরে যায়, খবরের পাপড়ি ঝরে যায়, কলি যায় শুকিয়ে। তারপর পত্রিকা অফিসে যখন পৌঁছে, তখন এডিটর সাহেব পাঠিয়ে দেন মফস্বল ডেস্কে। পান চিবাতে চিবাতে মফস্বল এডিটর সাহেব সেই শুকনো কলি ফেলে দেন ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। আর যদি কখনো ছাপা হয় বড়জোর দু-তিন লাইন। গত আগস্টে শৈলকূপায় স্বামীর প্রহারে স্ত্রীর মৃত্যু অথবা ভাণ্ডারিয়ায় স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা। কিন্তু আর কোনো সংবাদ নেই। আমি চাই দেশের ৬২টি জেলার সবকটিতে দৈনিক পত্রিকা থাকবে। বরিশাল বার্তা, চট্টগ্রাম বার্তা, রাজশাহী বার্তা, বগুড়া বার্তা, দিনাজপুর বার্তা প্রভৃতি।

চার. প্রতিটি জেলার নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও থাকবে জাতীয় আদলে প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।

পাঁচ. তাদের সঙ্গে এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন কোন বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা জাতীয় দৈনিক হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদ সংস্থা সম্পর্কেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ছয়. নির্বাচিত পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থা ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেখানে কর্মরত সব সাংবাদিক ও অন্য কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাবেন। এজন্য সাংবাদিক-কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন-ভাতা নিয়ে আসবেন।

সাত. চাকরিহীন সাংবাদিকদের নাম তালিকাভুক্ত এবং তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করার জন্য তোদের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হবে।

উল্লেখ্য, রিয়াজ ভাইয়ের প্রবন্ধের ভাষায়, ‘আমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ভয় নেই, যেসব কাগজ থাকবে না, সেসব কাগজের সাংবাদিকরা সরকারি চাকরি পাবে। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ট্রেজারি থেকে ভাতা দেওয়া হবে।’ একই নিবন্ধের অন্যত্র রিয়াজ ভাই লিখেছেন, ১৬ জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো। ঘোষণার নাম ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স।’ এর আওতায় দেশের মাত্র চারটি পত্রিকা থাকল সরকারি নিয়ন্ত্রণে— ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা আর বাংলাদেশ টাইমস। যেসব কাগজ বন্ধ হলো, সেগুলোর সব সাংবাদিক-কর্মচারীর চাকরি সরকারের হাতে ন্যস্ত হলো। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ভাতা দেওয়ার বিধান রাখা হয়। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মো. খালেদ ও বিপিআইএ-র প্রধান মিজানুর রহমানকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন দৈনিক বাংলা-টাইমস ট্রাস্টের প্রশাসক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী।

এবার আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক নেতাদের আলোচনায় ফিরে আসি। এখানে রিয়াজ ভাই লিখেছেন, আমার আর লেখার দরকার হতো না। কারণ সাংবাদিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছিল, তার কথা বলতে গিয়ে রিয়াজ ভাই শুধু ফিদেল কাস্ত্রো, সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন, সেকথা বলেই প্রসঙ্গটির ইতি টানেন। তবে তিনি বেমালুম চেপে যান বঙ্গবন্ধুর ঈপ্সিত পরিকল্পনার কথা। সংবাদপত্রের সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনেও যে বিপুলসংখ্যক মেধাবী সাংবাদিকের প্রয়োজন হবে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে ইউনিয়ন নেতারা আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাংবাদিকতায় যে ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে, সেখানে পূর্ণাঙ্গ স্নাতক সম্মান ও মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স খোলা এবং প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, বিদেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবাদিক সৃষ্টি করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু নেতাদের এসব সুপারিশ ত্বরিত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। বিশেষ করে সাংবাদিক নেতারা তৎকালীন সংবাদপত্র শিল্পে বিরাজমান করুণ অবস্থা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধুকে জানান, হাতেগোনা ২/৪টি সংবাদপত্র ছাড়া কোথাও নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না। আলু-পটলের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধান্ধায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকদের একটি আইডি কার্ড ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয় না। অনেক গ্রামীণ সাংবাদিক কেবল কলাটা-মূলাটা নিয়ে এ মহান পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন।

এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দেশের সব শ্রেণির সংবাদপত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা এক বিরাট বিপ্লব সাধন করবে বলে সাংবাদিক নেতারা মতপ্রকাশ করেন। এতে দেশের মেধাবী মুখের সন্ধান পাওয়া যাবে পত্রিকা অফিসগুলোতে। এ পরিকল্পনার জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানান। তারা এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালে যোগদানের আকাঙ্ক্ষাও তাকে জানান। পরবর্তী সময়ে গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজউদ্দিনসহ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক বাকশালে যোগদানের জন্য আবেদন করেন।

আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার সুবাদে আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। অন্য সাংবাদিকদের অনুসরণ করে আমিও তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতাম। একদিন স্যার তার বাসায় নৈশভোজের দাওয়াত দিলেন। বলেছিলেন, ঢাকা থেকে দুজন মেহমান এসেছেন, তাদের সৌজন্যে এ খানাপিনার আয়োজন। বাসায় গিয়ে দেখি আমাদের প্রিয় ফয়েজ ভাই (ফয়েজ আহমদ) ও বঙ্গবন্ধু সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। কথায় কথায় সেদিন বন্ধ হওয়া পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের তালিকাসহ প্রভৃতি বিষয় আলোচনায় আসে। অধ্যাপক খালেদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এ তালিকা প্রস্তুতের প্রশ্নে কোনো প্রকার মতপার্থক্যের বিষয় বিবেচনায় আনিনি। তদুপরি যারা মাত্র ৮০ থেকে ১১০ টাকা মাইনে পেতেন (অনিয়মিত), তালিকা প্রস্তুতকালে বঙ্গবন্ধুর স্বজ্ঞাতে তাদের বেতন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লেখা হয়েছিল। গিয়াস কামালসহ আমরা সবাই একমত হলাম যে, টাকাটা যখন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় ট্রেজারি থেকে দেওয়া হবে, তখন থাক না একটু বেশি অঙ্কের হিসাব। যা-ই হোক, সেই প্রস্তুত করা তালিকা হিসেবে দেশের সব সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারী সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির দিন পর্যন্ত দেশের সব সংবাদপত্রসেবী এ বেতন-ভাতা ভোগ করেছেন।

সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস কামাল চৌধুরীর মুখে শুনেছিলাম, তারা একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ সদ্য স্বাধীন, অর্থনৈতিক সংকট, অভাব-অনটনে আপনার সরকার জর্জরিত, এ সময় কাজ না করে প্রতি মাসে ট্রেজারি থেকে বেতন আনতে অনেক সাংবাদিকের মনে হোঁচট লাগে, আপনি আমাদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করুন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে তাদের সামনেই নির্দেশ দিয়ে দিলেন, সব অফিসের শূন্যপদে সাংবাদিক নিয়োগ দাও। তা হয়েছিলও। সদ্য স্বাধীন দেশে খাদ্য, শিপিং, ওয়াপদা, পর্যটন, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান এবং কাস্টমসহ বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে সাংবাদিকদের আত্মীকরণ করা হয়েছিল। তবে সবচেয়ে হূদয়স্পর্শী কাহিনীটি শুনেছি নির্মলদার কাছে।

প্রেস ক্লাবে বসে একদিন এক সাবেক সাংবাদিককে দেখিয়ে নির্মলদা বললেন, ওই ভদ্রলোককে চেনেন? তা না চেনার কারণ ছিল না, হ্যাঁ বলতেই নির্মলদা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় একদিন তিনি আমাকে বিশেষভাবে একটি চাকরির তদবির করার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। চাকরির কথা শুনে আমি বিব্রত হই। কারণ ওই চাকরিটা ছিল সর্বজ্ঞাত একটি ঘুষের চাকরি। ইউনিয়নের নেতা হিসেবে তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে বাধ্য হই। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক তাকে চাকরিটি দিলেন। তিনি রাতারাতি ‘ফকির’ থেকে ‘আমির’ বনে গেলেন চাকরিটির বদৌলতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানেন, একদিন তিনি এসে ক্লাবে আমার পাশে বসেন। সৌজন্যতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কেমন আছেন? তিনি উত্তর দেন, ‘কেমন আর থাকব! পেশায় তো থাকতে দিলেন না, তাড়িয়ে দিলেন। কোনোমতে বেঁচে আছি।’

তার এ উত্তরে নির্মলদা শুধু হতবাকই হননি, তার হূদয়ে যে বর্শা বিঁধেছিল তা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল। তাকে বললাম, ‘দাদা, আপনি আমাদের পেশার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। আপনার মনোবেদনা বুঝতে পারি। কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো একজন রাষ্ট্রপ্রধান বলতে পেরেছিলেন, ‘একজন সাংবাদিকও বেকার থাকবে না। যতদিন চাকরি না হয় ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসবে।’ পৃথিবীর কোনো ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান দেশের একটি গোটা পেশাজীবী সম্প্রদায়কে এভাবে ট্রেজারি থেকে বিনা কাজে বিনা চাকরিতে বেতন নিয়ে আসতে বলতে পারেননি। এই দুঃসাহস কেবল বঙ্গবন্ধু দেখাতে পেরেছিলেন। আর আজ কিছু ধান্ধাবাজ এই বলে মেকি ইতিহাস তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু সব সংবাদপত্র বন্ধ করে সাংবাদিকদের বেকার করেছিলেন। ধিক তাদের চতুর মনোবৃত্তির! তবে মিথ্যাচার ও তথ্য-সন্ত্রাসের অভিযোগে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে। এবং সেদিন খুবই নিকটবর্তী।

 

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর ও বাংলাদেশ নিউজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads