• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
জীবনের পথে মানুষ হাঁটবে

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

কোভিড-১৯

জীবনের পথে মানুষ হাঁটবে

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২০

চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে গত বছরের শেষদিকে প্রথম দেখা দেয় করোনা ভাইরাস। প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণ উহানে সীমাবদ্ধ থাকলেও, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। ইতোমধ্যে কেড়ে নিয়েছে অর্ধ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব আজ হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। জারি রয়েছে বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা। থমকে গেছে সকল কর্মকাণ্ড। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা। থমকে আছে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যও। সেই স্থবিরতা আমাদের এখানেও। মানুষের জীবন বাঁচাতে দেশে দেশে চলছে লকডাউন, কোথাওবা কারফিউ। আমাদের এখানেও করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ছুটি ঘোষণা করেছে। প্রথম দফা ছুটি শেষে তা আবার বাড়ানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষ সুস্থ থাকুক, নিরাপদ থাকুক। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছি আমরা। নানা অজুহাতে বেরিয়ে পড়ছি ঘর থেকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বারবার প্রচার হচ্ছে গণমাধ্যমে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও তাদের গাড়ি থেকে হ্যান্ড মাইকে বারবার প্রচার করছে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যেতে। কিন্তু তা যে মানা হচ্ছে না ঠিকঠাক তা তো আজ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কঠোর হওয়ার কথাও বলছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই, কোনো ভীতিই যেন আমাদের ঘরে আটকে রাখতে পারছে না। যারা হতদরিদ্র, যারা দিন এনে দিন খান, তাদের তো খাবার জোগাড় করতে বেরুতেই হয়, কিন্তু যাদের সেই সমস্যা নেই, তারাও নানা অজুহাতে বেরিয়ে পড়ছেন। এসব মানুষদের বাইরে বেরিয়ে পড়া, গলির মুখে, চায়ের দোকানের আড্ডায় তাদের মেতে ওঠার দৃশ্য হরহামেশাই তুলে ধরছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। অথচ হাসি-ঠাট্টা-তামাশা কিংবা গল্পের সময় এটি নয়। সারা বিশ্ব আজ কাঁদছে। প্রতিদিন যেভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক এই মহামারী আজ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে পৃথিবীকে। ইউরোপ, আমেরিকাও লন্ডভন্ড। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন, কারফিউয়ের মতো কর্মসূচিও নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। উদ্দেশ্য একটাই মানুষ যেন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে। কারণ প্রতিষেধক অজানা এই রোগের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র হাতিয়ার আলাদা হয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। ভাইরাস, এই শব্দটির মাঝেই রয়েছে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার তরিকা। ভিআইআরইউএস— এই ইংরেজি বর্ণগুলো মিলে হয় ভাইরাস। এ থেকে যদি শুধু আই এবং ইউ-কে আলাদা করে ফেলা হয়, সেটাই আপাতত করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার তরিকা। প্রতিষেধক না থাকা ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যত বেশি পরীক্ষা করা হবে তত কমে আসবে এই রোগের প্রকোপ। কারণ পরীক্ষা করে কারো শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি মিললেই তাকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। যাতে করে তার থেকে অন্য কারো শরীরে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা না থাকে। এজন্যই জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তি সচেতনতাকে। ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা এবং নিজেকে অন্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটাকে করোনা মোকাবিলার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরে থাকার এই নীতিকে কাজে লাগিয়েই কোনো কোনো দেশ আটকেও দিয়েছে করোনার অপ্রতিরোধ্য গতি। বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করেছে এই নীতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে গতিতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, আশার কথা আমরা সেই ঝড় থেকে এখনো মুক্ত। ইতোমধ্যে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়া এবং করোনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও ইউরোপ, আমেরিকার মতো ভয়াবহ নয় আমাদের অবস্থা। আর এ কারণেই আমাদেরকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমান সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশ থেকে যারা ইতোপূর্বে দেশে এসেছেন, এই সময়ে তাদের কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষ হবে। দেশের ভেতরেও যারা তাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদেরও কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন করে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা যেন না বাড়ে সে জন্যই আমাদের ঘরে থাকা জরুরি। এতে করে ব্যক্তি আমি যেমন, তেমনি আমার পরিবারের সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে। এ অবস্থায় মানুষ তথা আমরা যত বেশি ঘরে থাকব, যত বেশি অন্যের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।

সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা হয়তো খুব শিগগিরই এই সংকট কাটিয়ে উঠব। কিন্তু তার আগেই, আমাদের অসচেতনতায় যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি আমাদের প্রিয়জনকে। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় এনে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানেও কাটছাঁট করেছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে। আমাদের স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতি সৌধে শহীদদের স্মৃতিতে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভব হয়নি। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারি ছুটি শেষেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব নববর্ষ। পহেলা বৈশাখের সেই অনুষ্ঠানও সরকার স্থগিত করেছে। এর সবই করা হয়েছে মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইছে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। সরকার চাইছে আমরা সুস্থ থাকি, নিরাপদ থাকি। সরকারের এই আন্তরিকতায় আমাদেরও সাড়া দেওয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশ থেকে এসে, উন্নত দেশের শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ না করে আমাদের প্রবাসী স্বজনদের অনেকে যে ভুল করেছেন, আমরা যেন তার পুনরাবৃত্তি না করি। ঘরে থাকার সুবিধার্থে সরকার যে ছুটি দিয়েছে, আমরা সকলেই সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করি তা যথাযথভাবে মেনে চলার। আমরা যদি সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকি, নিজেকে সুস্থ রাখি তাহলেই সম্ভব পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। তাহলেই আবার আমরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাব। আজ বিভিন্নভাবে আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি, সেই ক্ষতির ভাগীদারও তো সবাই। কারণ প্রত্যেকের মাধ্যমেই সচল থাকে অর্থনীতি। যদি আমরা সুস্থ থাকি, তাহলে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে আজকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু এজন্য আগে চাই সুস্থতা। আগে চাই সচেতনতা। ধৈর্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সুদিন আসবেই। দুঃসময় কেটে যাবে। জীবনে আলো আসবেই। সেই আলোকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে মেখে নিতে হলে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে হবে। যা শুধু ঘরে থাকার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। আমরা যেন ভুলে না যাই, জীবনের চেয়ে দামি কিছু নেই।

 

লেখক : সাংবাদিক, কবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads