• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

জাতিসংঘের সফলতা ও ব্যর্থতা

  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০২০

মো. তাসনিম হাসান আবির

 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশন গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হয়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে জাতিসংঘের ইতিহাসে এবারই প্রথম ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অধিবেশনটির উচ্চ পর্যায়ের বিতর্ক শুরু হয়েছে গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে। নিজ নিজ দেশ থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মের মাধ্যমে এবারের সভায় অংশগ্রহণ করছে।

এবারের সাধারণ বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'The future we want, the United Nations we need: reaffirming our collective commitment to multilateralism -  confronting COVID-19 through effective multilateral action'। মূলত ২০২০ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তি ও মহামারী কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবকে উপজীব্য করে এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অধিবেশন যেমন বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বহুপাক্ষিকতাবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে নিয়ে আসবে, তেমনি বিশ্বনেতারা আগামী বছরগুলোতে কী ধরনের জাতিসংঘ দেখতে চান সে বিষয়ে তাদের অভিমত, চিন্তাধারা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরে এসে সবার মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, জাতিসংঘ আসলে কতটুকু সফলতা পেয়েছে বা কতটুকু ব্যর্থ হয়েছে! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত দিক নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

প্রথমত, বর্তমান বিশ্বের সবথেকে আলোচিত ইস্যু হচ্ছে ফিলিস্তিন সংকট। আমরা কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি যে, এ বিষয়ে জাতিসংঘের ব্যর্থতা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। অসহায় ফিলিস্তিন জাতির নিজেদের জমি ইসরাইল দখল করে বসতি স্থাপন করছে আর ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করছে। ইসরাইলকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করছে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিনিয়ত ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজায় বোমা নিক্ষেপ করছে, তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের অবরুদ্ধ করছে, তাদের সন্তানদের পঙ্গু করে দিচ্ছে। এমনকি অমানবিকভাবে ত্রাণকাজেও বাধা দিচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ বিশ্ব দেখেনি। তাদের ব্যর্থতা অসহায় ফিলিস্তিনিদের চোখে-মুখে ভেসে বেড়ায়!

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকট। মিয়ানমার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে প্রায় ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তখন শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তাদের জীবন রক্ষার স্বার্থে। অথচ আজ এতদিন পার হয়ে গেলেও জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তারা মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় করে দিতে পারেনি। বাংলাদেশের ঘাড়ে রোহিঙ্গা সংকট চাপিয়ে দিয়ে তারা দায় এড়াতে ব্যস্ত। এটা বাংলাদেশের জন্য যেমন সংকট তেমনি বিশ্বেরও সংকট বটে।

তৃতীয়ত, কাশ্মীর সংকট। ভারতের কাশ্মীর রাজ্যে দিনের পর দিন মুসলিম জাতি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আসছে। কাশ্মীরিদের নিজেদের রাজ্যে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নিয়মিত তাদের ওপর হামলা, মামলা, অত্যাচার করা হচ্ছে। তরুণ কাশ্মীরিদের পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে। আবার তরুণীরা ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মীরিদের অধিকার খর্ব করেছে ভারত সরকার। অথচ এ বিষয়ে জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকায়! ফলস্বরূপ কাশ্মীর সংকট সমাধানেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।

চতুর্থত, সিরিয়া ও ইয়েমেনের যুদ্ধ। বছরের পর বছর ধরে সিরিয়া ও ইয়েমেনে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তাদের ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে এই দুটি দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুহারা হয়ে অভিবাসী হয়েছে কোটি মানুষ। অথচ এখানেও জাতিসংঘ সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। তাদের সফলতা ওই ত্রাণ কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে গরিব দেশ ইয়েমেনও রক্ষা পায়নি বিশ্বদানবদের হাত থেকে। তাদের অসহায় শিশুদের কান্নার আওয়াজ জাতিসংঘ শুনতে পায় না। তাই বিশ্বের দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংঘ হয়েও তারা ইয়েমেনে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ।

পঞ্চমত, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অশান্তি। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ফেরাতেই জাতিসংঘের আবির্ভাব হয়েছিল। অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুগের পর যুগ ধরে চলা মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি নিরাময়ে তারা ব্যর্থ। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতার দাপটে বলি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। তাদের রক্তে তথাকথিত বিজয়ের হাসি হাসছে বিশ্বশক্তি। নিজেদের ভূমি ফেলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে অন্যের দাসত্ব বরণের জন্য। আর জাতিসংঘ বরাবরের মতোই প্রেস রিলিজ দিয়ে তাদের শান্তির দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে।

ষষ্ঠত, কোরিয়া ইস্যু। দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বিবদমান সংকট অনেক পুরনো। তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত বিশ্ব দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং কয়েকবার আলোচনাও করেছেন, তবে সেটি ফটোসেশন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাস্তবিক কোনো সমাধান বিশ্ব দেখেনি। আর জাতিসংঘও এ বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি যাতে দুই কোরিয়ার মাঝে শান্তি ফিরে আসে।

সপ্তমত, মার্কিন মুলুকের একক আধিপত্য। বিশ্বে মার্কিনিদের আধিপত্য যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। তাদের অস্ত্রের সামনে পুরো বিশ্বকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতে হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘও মার্কিনিদের আধিপত্যের প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থে একের পর এক শান্তিপূর্ণ দেশকে অশান্ত করে তুলছে, তারপর তাদের চিরাচরিত অস্ত্র ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য কাঁপছে। অথচ জাতিসংঘ তাদের কাঠের পুতুল হয়ে বসে আছে। কারণ হয়তোবা জাতিসংঘের কোষে মার্কিনিদের সবথেকে বেশি অর্থ সহায়তা আছে। মার্কিনিদের সর্বক্ষেত্রে অবৈধ নগ্ন হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারা জাতিসংঘের অন্যতম একটি ব্যর্থতা।

অষ্টমত, ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ প্রসঙ্গ। জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচটি দেশ— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন ভেটো ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ জাতিসংঘের যে কোনো সিদ্ধান্ত এই কটি দেশের যে কোনো একটি ভেটো দিয়ে ভেস্তে দিতে পারে। ইতঃপূর্বেও আমরা এর নমুনা দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেদের স্বার্থে এই দেশগুলা ভেটো দিয়ে সমাধানের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘ এই ভেটো পাওয়ারের কোনো ভারসাম্য আনতে পারেনি। যার ফলে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে এখন প্রকাশ্যেই আলোচনা, সমালোচনা চলছে। জাতিসংঘের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটাও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।

নবমত, জলবায়ু প্রসঙ্গ। জলবায়ু প্রশ্নে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘ পারেনি। উন্নত দেশগুলোর দ্বারা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের ফল ভোগ করতে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা নিয়মিত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ উন্নত দেশগুলোর লাগামহীন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের ফলে প্রকৃতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে একটি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকা হতাশাজনক।

দশমত, বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ। দিনকে দিন বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সন্ত্রাসবাদের বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষ। কিন্তু জাতিসংঘের এই ৭৫ বছরে এসে যখন সন্ত্রাসের পরিমাণ কমার কথা, তখন তা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের একতার প্রতীক জাতিসংঘ এই সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ উদঘাটন করে তার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে এসেও গণহত্যার শিকার হতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। ইরাকের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপও বন্ধ করতে পারেনি জাতিসংঘ। বিশ্বশক্তি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ইরাকে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে, যা কাম্য নয়।

তবু এত ব্যর্থতার মাঝেও জাতিসংঘের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বের একতার প্রশ্নে জাতিসংঘের মতো একটি প্লাটফর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের যে কোনো দেশের, যে কোনো সমস্যায় আমরা জাতিসংঘে গিয়ে উপস্থাপন করতে পারি। ভবিষ্যতের যে কোনো বিশ্ব সংকটেও জাতিসংঘের কার্যকর উপস্থিতি আমাদের কাম্য। সুতরাং জাতিসংঘের কাছে আমাদের কামনা অন্ধের আয়না দেখার মতো না থেকে অসহায়ের পাশে দাঁড়ান, ত্রাতার ভূমিকা পালন করুন। সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা যেন জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য হয়।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads