• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আমিরাত-বাহরাইনের শান্তি চুক্তি কতটা শান্তি ফেরাতে পারবে

  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০২০

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

 

 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিন অধ্যুষিত আরব এলাকা বিভক্ত করে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। সেখানে ফিলিস্তিনের মোট ভূমির ৫৬.৫% নিয়ে ইহুদি অধ্যুষিত ইসরাইল রাষ্ট্র এবং ৪৩.৫% ভূমি নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। মোট জনগণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল মোট ভূমির অর্ধেকেরও বেশি পায়। ১৯৪৮ সালের ১২ মে ঠিক রাত ১২টায় ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এর ১০ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেনও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। তখন থেকেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধের শুরু। এরপর ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে আরবদের সঙ্গে ইসরাইলিদের হয়ে গেছে চারটি যুদ্ধ, হয়েছে অসংখ্য শান্তি চুক্তি, ঝরে গেছে বহু নিরীহ প্রাণ। কিন্তু সেখানে কোনো স্থায়ী সুরাহা আজো হয়নি। বরং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরবদের আগ্রহ কমছে, বেড়েছে বিভক্তি, ফুটে উঠেছে মতাদর্শগত ভিন্নতা।

মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরাইলিদের দখলদারিত্ব কখনোই মেনে নেয়নি আরব রাষ্ট্রগুলো। ফলস্বরূপ ইসরাইলের সঙ্গে চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে তারা। ইসরাইল ১৯৬৯ সালে জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদ মসজিদুল আকসায় আগুন ধরিয়ে দিলে বিশ্বের মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। এই নিন্দনীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরেই সৌদি বাদশা ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ঙৎমধহরুধঃরড়হ ড়ভ ওংষধসরপ ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ (ঙওঈ)। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ আন্তঃদেশীয় সংগঠনটির নীতিবাক্য হলো— মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা, অগ্রগতি ও মঙ্গল নিশ্চিতকরণ। ঙওঈ-এর ৭টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর মধ্যে ৫ নাম্বারটি ছিল— পবিত্র স্থানসমূহের নিরাপত্তা বিধানের সংগ্রামকে সমন্বিত ও সুসংহত করা, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করা এবং তাদের অধিকার আদায় ও স্বদেশ রক্ষার কাজে সাহায্য প্রদান। কিন্তু বর্তমানে অনেক আরব দেশই এই নীতিমালা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে সরে গেছে। যার ফলে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

২০০২ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয় যে, যতক্ষণ না ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত ফিলিস্তিনি জমি ছেড়ে দিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আরব-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। এর আগেই অবশ্য দুটি আরব দেশ মিসর ১৯৭৮ সালে এবং জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে। এখানে একটি কথা বলতে হয়, এই দুটি দেশেরই ইসরাইলের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এবং ১৯৬৭ সালে তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়। সেই যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে মিসর হারায় সিনাই মরুভূমি এবং জর্ডান হারায় পশ্চিম তীর। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির ফলে মিসর তার হারানো সিনাই মরুভূমির মালিকানা ফিরে পেলেও মিসরের প্রেসিডেন্টকে তার জীবন দিয়ে এই চুক্তির মূল্য চুকাতে হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি পারস্য উপসাগরীয় দুটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি চুক্তি আরব বিশ্বের মধ্যকার বিভাজনকেই প্রকট করে তুলেছে। যেখান ইসরাইল কাউকে পরোয়ানা করে না, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে নিজেদের বসতি নির্মাণ করে চলছে, সেখানে আরববিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো প্রতিরোধ তো গড়ে তুলছেই না বরং ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাত এবং বাহরাইনের চুক্তির পেছনে প্রচ্ছন সমর্থন রয়েছে সৌদি আরবের। এমনকি এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ট্রাম্পের তথাকথিত ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চুক্তি’তে সমর্থন জানিয়েছিল সৌদি আরব, মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। অথচ ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলনই ছিল না সেই চুক্তিতে।

তবে ফিলিস্তিনিরা অনারব দেশ ইরান এবং তুরস্ককে তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখে নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবে। উপসাগরীয় দেশ ওমান এবং কুয়েতও ফিলিস্তিন সংকটের কোনো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের সঙ্গে কোনো ধরনের শান্তি চুক্তির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছে। আফ্রিকার দেশ সুদানকে পক্ষে টানার চেষ্টা করলেও সেভাবে সফল হতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নাজুক অর্থনীতিতে জর্জরিত সুদান তাদের সিদ্ধান্তে কতটা অটল থাকতে পারবে সেটা সময়ই বলে দেবে।

গত অর্ধ শতাব্দী ধরে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ছিল আরব দেশগুলো। ইসরাইলের যে কোনো ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ একসঙ্গে করেছে তারা। কিন্তু বর্তমানে বিভক্ত মধ্যপ্রাচ্য ফিলিস্তিন ইস্যুতেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। অথচ একটি স্থিতিশীল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সব থেকে জরুরি যে বিষয়টি, সেটি হলো আরববিশ্বের দেশগুলোর ঐক্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আরব বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক অনেক জটিল এবং নানা কারণে বিভিন্ন সময় প্রভাবিত হয়ে থাকে। আরব বিভক্তিতে ইসরাইলের লাভ, আরবরা এটা বুঝতে চায় না নাকি বুঝতে পারে না সেটা একটা বড় প্রশ্ন এ মুহূর্তে। তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বার বার সুযোগ করে দিয়েছে পশ্চিমাদের এই অঞ্চলে নাক গলানোর। মধপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের থিওরি হলো ‘ডিভাইন রুল’। আরবরা যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পারবে, তাদের জন্য ততই মঙ্গল।

 

লেখক : শিক্ষার্থী

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads