• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সীমান্তরক্ষীদের অবদান

  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০২০

মু. আবদুল আউয়াল মুছুল্লী

 

 

 

এ দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং শোষণ-বঞ্চনা থেকে তাদের মুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আপামর জনতা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশের মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।

মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা অসীম মনোবল আর সামান্য কিছু সাধারণ মানের অস্ত্র সম্বল করে যে অগাধ দেশপ্রেম, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে ঢাকার পিলখানাস্থ ইপিআর সদর দপ্তর। তৎকালীন ইপিআর বাহিনী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসযোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়। নিজস্ব ওয়্যারলেসযোগে প্রচারের এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেন শহীদ সুবেদার মেজর (সিগন্যাল) শওকত আলী।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি কয়েকজন ছাত্রনেতার মাধ্যমে পিলখানার ২ নম্বর গেটে সুবেদার মেজর শওকত আলীর কাছে পৌঁছে। তিনি সেটি পিলখানাস্থ ইপিআর ওয়্যারলেসযোগে টেলিগ্রাফিক মেসেজের মাধ্যমে কোম্পানি হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন।

চট্টগ্রামে ইপিআরের কর্তব্যরত সিগন্যালম্যান মোঃ আবুল খায়ের মেসেজটি গ্রহণ করেন এবং ইপিআরের বাঙালি অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে হস্তান্তর করেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি প্রেরণের অপরাধে সুবেদার মেজর শওকত আলীকে পিলখানাস্থ বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করে। এ দুঃসাহসী বীরযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অমানুসিক নির্যাতন করে এবং পরবর্তী সময়ে তাকে হত্যা করা হয়। তার প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ইপিআর সিগন্যাল সেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সারা দেশের সীমান্ত বিওপিতে, যা ইপিআর সদস্য ছাড়াও মুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা রণকৌশলগত কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর তীরে জিঞ্জিরায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিআরের বাঙালি সৈনিকরা ১১টি সেক্টরে ৯ মাস যুদ্ধে নিয়োজিত থাকেন।

ইপিআরের প্রায় ৮ হাজার বাঙালি সদস্য সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও সিলেটে ইপিআরের বাঙালি সদস্য ও পাকবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইপিআরের বাঙালি সৈনিকদের এ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে অধিকতর সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস জুগিয়েছে।

দেশের প্রতিটি সেক্টর ও উইং হেডকোয়ার্টারের বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং বিভিন্ন পদবির সৈনিকরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ, আত্মঘাতী আক্রমণ ও শত্রুঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে অসংখ্য দুর্ধর্ষ অপারেশন পরিচালনা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম বীরত্বের জন্য এ বাহিনীর দুজন সৈনিক সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত হন। তারা হলেন- শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ। তাদের বীরত্বগাঁথা এ বাহিনী তথা বাঙালি জাতিকে করেছে গৌরবান্বিত। তাদের সম্মানে পিলখানাস্থ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে-বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ।

এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের জন্ম ও শাহাদাৎ বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে স্বজনদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে সম্মানিত করা হয়ে থাকে। এছাড়া এ বাহিনীর আরো ৮ জন বীর-উত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম, ৭৭ জন বীরপ্রতীক খেতাব অর্জন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর মোট ৮১৭ জন বীর সৈনিক শাহাদাৎ বরণ করেন। এ বাহিনীর অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে সরকার এ বাহিনীকে ‘স্বাধীনতা পদক ২০০৮’ প্রদান করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজিবি (তৎকালীন ইপিআর) সৈনিকদের হিমালয়সদৃশ মনোবল, অতুলনীয় দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বিজিবির সৈনিকরা তাদের পূর্বসূরী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মহিমায় গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। তাই এ বাহিনী দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সর্বদা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানিয়ে থাকে।

প্রতি বছর বিশেষ করে বিজিবি দিবস উপলক্ষে এ বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে বিজিবি সদর দপ্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ বাহিনীর দুই বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের বিশেষভাবে সম্মান জানানো হয়ে থাকে। ঢাকা অঞ্চলে বসবাসকারী এ বাহিনীর অন্যান্য খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও একইভাবে সংবর্ধিত করা হয়।

গত বছর ১৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো বিজিবির খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ বিজিবির সব জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে বিজিবি সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। শহীদ ও পরলোকগত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তাদের পরিবারের প্রতিনিধিরাও ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

বিজিবি সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি বিজিবির সব মুক্তিযোদ্ধার মিলনমেলায় পরিণত হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজিবি মহাপরিচালক উপস্থিত থেকে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের কুশলাদি অবহিত হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের এ আয়োজনের মাধ্যমে বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাঁথা সম্পর্কে এ বাহিনীর বর্তমান সদস্যরা সরাসরি জানার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এভাবে এ বাহিনীর সদস্যরা তাদের পূর্বসূরীদের বীরত্বের নিদর্শন নিজেদের মধ্যে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত হন।

শুধু প্রথাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সমস্যাদি জেনে তাদের পাশে থেকে এ বাহিনী কল্যাণমূলক কাজও করে থাকে। বিজিবির নিজস্ব তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তাসহ তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মেরামতে সহায়তা করা হয়।

এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিজিবি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম ও কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের নিদর্শন স্থাপন করেছেন, তেমনি বিজিবির বর্তমান সদস্যরাও সীমান্ত রক্ষায় তাদের ওপর অর্পিত মহান দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দায়বদ্ধতা থেকে বিজিবির গৃহীত পদক্ষেপগুলো সত্যিই প্রশংসনীয়, যা দেশবাসীর কাছে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।

 

 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, পিলখানা, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads