• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আমৃত্যু সংগ্রামী মওলানা ভাসানী

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২২ নভেম্বর ২০২০

প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা তাদের কর্মময় জীবনের আলোয় চারপাশ আলোকিত করেন। তারা ইতিহাস নির্মাণ করেন, ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেন এবং নিজেরাই পরিণত হন ইতিহাসে। তারা হতে পারেন বিজ্ঞানী, হতে পারেন সমাজসংস্কারক, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক পীর, সমাজসংস্কারক এবং রাজনীতিক। তবে অন্যান্য পরিচয় ছাপিয়ে তার রাজনীতিক পরিচয়টিই বড় হয়ে উঠেছে। তিনি এমনই একজন রাজনীতিক ছিলেন, যাকে বিশেষ কোনো অভিধার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা মুশকিল। তার ভক্ত-অনুরাগীরা তাকে ‘আফ্রো-এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর’ অভিধায় অভিহিত করতেন বা এখনো করেন। আমরা যদি মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের পর্যালোচনা করি, তাহলে উল্লিখিত অভিধা সর্বাংশে যুক্তিযুক্তই বলে মানতে হবে। কেননা তিনি তার পুরোটা জীবন ব্যয় করেছেন নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করে। যুবক বয়সে এলাকার প্রতাপশালী জমিদারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিদ্রোহ দিয়ে যার সংগ্রামী জীবনের শুরু, সে সংগ্রাম অব্যাহত ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। বলা যায়, আমৃত্যু সংগ্রামী ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার মতো সংগ্রামী নেতা উপমহাদেশ তো বটেই বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের অনেক নেতাই দীর্ঘ সংগ্রাম করে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মওলানা ভাসানীকে রাষ্ট্রক্ষমতার লোভ কখনো আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তার দল রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েছে, কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন ক্ষমতার বাইরে। আর সেজন্যই তিনি নিজ দলীয় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির প্রতিবাদে দলের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘটনা তার রাজনৈতিক জীবনে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। কতটা নির্লোভ এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন হলে নিজের প্রতিষ্ঠিত দলের সভাপতির পদ এক কথায় ছেড়ে দিতে পারেন, তা ভেবে দেখার মতো।   

গত ১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার ছিল সেই ক্ষণজন্মা নেতার ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি অনেকটা যেন নীরবেই চলে গেল। তার মতো ইতিহাস সৃষ্টিকারী একজন নেতাকে যেভাবে স্মরণ করা দরকার তা হয়নি। অবশ্য তার অনুসারীদের অনেকে ওইদিন সন্তোষে তার মাজার শরিফ জিয়ারত করেছেন। অর্পণ করেছেন পুষ্পস্তবক। ছোট দুটি আলোচনাসভার খবর পাওয়া গেছে ঢাকা ও খুলনায়। কিন্তু কেন এই মহান নেতার প্রতি এমন অবজ্ঞা-অবহেলা? বর্তমানে দেশে যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল রয়েছে, এই দুটো দলের পেছনেই রয়েছে তার অসামান্য অবদান।  আওয়ামী লীগের তিনি প্রতিষ্ঠাতা, আর জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি তার অনুসারীদের যে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন, তারই ফসল হলো বিএনপি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়ার নেতৃত্বে ভাসানী ন্যাপ তাতে মুখ্য ভূমিকায় ছিল। বলা যায়, বিএনপির ভেতরে প্রগতিশীল অংশটি মওলানা ভাসানীর অনুসারী। এমনকি বিএনপি এখন যে ধানের শিষকে তাদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে, তাও এসেছে মওলানা ভাসানীর কাছে থেকে। ধানের শিষ মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নির্বাচনী প্রতীক ছিল। অথচ বিএনপির অনেকেই তা জানেন না। আমি দলটির অনেক নেতাকর্মীকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা বলতে পারেননি ধানের শিষ প্রতীকটি কীভাবে তাদের হলো। ন্যাপের বিএনপিতে লীন হওয়ার ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর ইঙ্গিতের কথা সে সময় মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়া একাধিকবার সংবাদ মাধ্যমে ব্যক্ত করেছিলেন। মওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন, সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক  সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গড়ে তুলতে। আর সে কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগ তাদের এই প্রতিষ্ঠাতাকে স্মরণে আনতে চায় না। কেননা মওলানা তাদের এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তৈরির বীজ বপন করে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কথা থাক, বিএনপি কি মওলানা ভাসানীকে যথাযথ মূল্যায়ন করছে? গত ১৮ নভেম্বরের পত্রিকার খবরে দেখলাম, একজন জুনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব ততোধিক জুনিয়র কয়েকজন নেতা মিলে ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতার মাজারে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কেন দলের মহাসচিব এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যরা কী করেছেন? তারা কেন এই মহান নেতার প্রতি দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন না? বিষয়টি মওলানা ভাসানীর অনুসারী-অনুরাগীদের মনে যুগপৎ ক্ষোভ ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ মজলুম জননেতার প্রতি বিএনপির এই অবজ্ঞা ও অবহেলাকে নিমকহারামির সঙ্গে তুলনা করতে চান।

যা হোক আমরা এখন এই মহান নেতার কর্মময় জীবনের ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, মওলানা ভাসানীর মতো বিশাল মাপের রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে যে ধরনের গবেষণা হওয়া উচিত ছিল দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের স্মৃতিচারণ, ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু লেখকদের লেখায় তার কর্মময় জীবনের মূল্যায়নের প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তন্মধ্যে সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণাগ্রন্থ ‘ভাসানী’ এখনো পর্যন্ত মওলানার ওপর সবচাইতে তথ্যবহুল বই হিসেবে সমাদৃত। ওই বইতে মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। মওলানা ভাসানী রাজনীতিকে দেখেছেন মানবসেবার মাধ্যম হিসেবে। জীবনে তিনি অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৪৯ সালে তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা ১৯৫৫-তে এসে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। অসাম্প্রদায়িক ভাসানী দলটিকে অসাম্প্রদায়িক পরিচয় দিতে নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন; যদিও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বেশ কয়েকজন নেতা এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সে দলে শেষ পর্যন্ত তিনি থাকতে পারেননি। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দীর সাথে মতদ্বৈধের কারণে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন দলটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি মওলানা সাহেবকে দলত্যাগ থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মওলানা তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তবে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত তার সে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি। ওই বছরই জুলাই মাসে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।

মওলানা ভাসানী ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। তার প্রতিষ্ঠিত শেষ সংগঠন ছিল ‘খোদা-ই-খিদমতগার’। ১৯৭৬ সালের ১৩ নভেম্বর ওই সংগঠনের প্রথম সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিগত ৭৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার হাত-বদল হতে কখনো-বা অতি নিকট হইতে কখনো-বা কিঞ্চিৎ দূর হইতে অবলোকন করিয়াছি। এই পর্যায়ক্রমিক পটপরিবর্তনের ধারায় আমি নিজেও সাধ্যমত সক্রিয়তা বজায় রাখিয়াছি। কিন্তু যে কৃষক-মজুর, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতী ও মেথর প্রভৃতি মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন আমি আবাল্য দেখিয়াছি এবং সেজন্য সংগ্রাম করিয়াছি, তাহা আজও সুদূরপরাহত রহিয়া গিয়াছে। তাই আমার সংগ্রাম শেষ হয় নাই। এই সংগ্রাম আজীবন চলিবে।’ (সূত্র : ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।

মওলানা ভাসানী উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও তার ছিল না। সাধারণ মক্তবে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে, বঞ্চিত মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, তিনি অর্জন করেছিলেন রাজনীতির সমুদ্রসম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। তাই যেটা তিনি আগেই উপলব্ধি করেছেন, অন্যান্য নেতা তা উপলব্ধি করেতে পেরেছেন দশ-বিশ বছর পরে। ১৯৭১-এ এসে আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। অথচ মওলানা ভাসানী এটা অনুভব করেছিলেন অনেক আগে ১৯৫৭ সালেই। সে বছর ৭-৮ ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানানোর কথা বলেছিলেন। এটা ছিল এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি আগাম বার্তা। 

মওলানা ভাসানী ছিলেন একাধারে রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতা। অনেকেই তাকে পীর মানতেন। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা থেকে আজীবন মুক্ত থেকেছেন। তিনি সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রবক্তা ছিলেন। খ্যাতনামা কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা এবং তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আলাউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেছেন, ‘তিনি রাজনীতি ও ধর্মের সমন্বয় সাধন করতে চেষ্টা করেছেন এবং ধর্মীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও জীবনের একটি সুদীর্ঘ সময় কমিউনিস্টদের সঙ্গে কাজ করেছেন। পীর হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং এই উপমহাদেশের শুধু সাম্প্রদায়িকতা নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেও তার কণ্ঠ সোচ্চার থেকেছে।’ (সূত্র : প্রাগুক্ত)।

বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি মূলত লড়াই করেছেন এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর, তাতি, মুটে, মোটকথা সর্বহারা মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এ জন্য তাকে শাসকচক্রের রোষানলে পড়তে হয়েছে, শিকার হতে হয়েছে জেল-জুলুম-নির্যাতনের। পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ছিনিমিনি খেলা এবং এ অঞ্চলের মানুষদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি তার বুকে জ্বেলে দিয়েছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুন। সে আগুনের হলকা তিনি সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণে।///////

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। প্রায় দশ লাখ মানুষ তাতে প্রাণ হারায়। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বা ওই সরকারের কেউ উপদ্রুত অঞ্চল দেখতে আসেননি। সে সময় দুর্গত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফিরে ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। তার সে ভাষণে লন্ডভন্ড উপকূলের দুর্গত মানুষের হাহাকারের যে চিত্র ফুটে উঠেছিল, সেটাকে উপজীব্য করে বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’। কবি শামসুর রাহমানের বর্ণনায় অতিশয়োক্তি নেই। তিনি ভাসানীর হাতকে বল্লমের সাথে তুলনা করেছিলেন। বস্তুত শাসক-শোষক গোষ্ঠীর কাছে মওলানা ভাসানীর উত্তোলিত হাত ছিল তীক্ষ বর্শার মতোই। ওই হাত দিয়েই তিনি বিদ্ধ করতে চেয়েছেন গণতন্ত্র, মানবতা, মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণকারী গণশত্রুদের। পল্টন ময়দানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন তিনি বজকণ্ঠে ‘খামোশ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেন, তখন সেখানে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসার পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠীরও হূদকম্প সৃষ্টি হতো।

অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন মওলানা ভাসানী। অর্থ-সম্পদ, বিত্তবৈভব অর্জনের কথা কখনো তার ভাবনায় আসেনি। সংসারের কথা ভাবেননি কখনো। জীবনে তিনি দুবার দ্বার পরিগ্রহ করেছেন। তার উভয় স্ত্রী ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তারাও তার সঙ্গে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন। শ্বশুরদের বিত্তকে তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন দুঃখী মানুষদের মধ্যে, ব্যয় করেছেন রাজনীতির পেছনে।

মওলানা ভাসানী বলতেন, ‘নেতাদের তোমরা বেশি জিন্দাবাদ দিও না। এতে নেতাদের মাথা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’ তার এ মন্তব্য যে কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালে তার সে মন্তব্যের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। নেতারা এখন আর সাধারণ মানুষের কাতারে থাকতে চান না, নিজেদের ভিন্ন এক প্রজাতির মনে করেন। নেতারা এখন জনগণকে কেবলমাত্র তাদের ভোটের উৎস বিবেচনা করেন। জনগণের প্রতি কর্তব্যের কথা তারা ভুলে যান। তল্পিবাহকদের জিন্দাবাদ ধ্বনি তাদেরকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, সেখান থেকে তারা ভূমিতে অবস্থানরত সাধারণ মানুষকে যেন দেখতেই পান না। তাই দেখা যায় রাজনীতিকদের একটি বিরাট অংশকে শুধু বিত্তবৈভব গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থাকতে।

যে জাতি তাদের পূর্বপুরুষদের কথা ভুলে যায়, সে জাতির বিপথগামিতা অবশ্যম্ভাবী। মওলানা ভাসানী সব দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া একজন মহান নেতা। দলীয় সংকীর্ণতার গণ্ডিতে তাকে আবদ্ধ করা ঠিক নয়। তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তাই দল-মত নির্বিশেষে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাকে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। না হলে  ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads