• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে হবে

  • প্রকাশিত ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

জান্নাতুল মাওয়া নাজ

 

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির ওপর নির্ভরশীল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উপখাত হলো বন। বৃক্ষ মানুষের জীবনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। জাতীয় অর্থনীতি এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম।

শত শত বছর ধরে বনের মাটিতে আপনা থেকেই জন্মায় বৃক্ষ, পুষ্টিকর নানান ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল। জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বন। বাংলাদেশে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় আঠারো শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বনভূমি, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চল। সুন্দরবন বাদ দিলে বন বলতে যা অবশিষ্ট থাকে তা সামান্যই। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের মতে, এর পরিমাণ মাত্র পাঁচ শতাংশ।

মানুষের জন্য সবুজ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা এবং জীবজগৎ ও প্রকৃতির সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ১৯৭৪ সাল থেকে ধরিত্রীর প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমিয়ে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে মানুষকে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফরম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেসের (আইপিবিইএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কয়েক দশক ধরে প্রায় এক মিলিয়ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে। 

জনসংখ্যার চাপে বনভূমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বনজসমপদ। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ নেমে আসায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে আবহাওয়ায়। বাতাস দূষিত হচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে মাটি। খাদ্য, ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল, শক্তি ও পরিবেশ সেবার যে অংশ আসে বন থেকে বৃক্ষনিধনের ফলে তা সংকটের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। যার ফলে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতুলনীয় সবুজ সৌন্দর্য।

বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার কারণে বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে আজকের পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে, এখনই সময় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করে সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার।

জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস রোধে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ প্রাণ ও প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণীসহ বনজ ও প্রাণিজসম্পদ ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা, নাগরিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। সর্বোপরি পৃথিবীতে মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে প্রকৃতি প্রদত্ত বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষা করেই বাঁচতে শিখতে হবে।

গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনজসম্পদ আহরণসহ নানা কারণে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশের মোট ভূমির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও প্রকৃত বন আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ আট ভাগের বেশি নয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩১ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি জবরদখলের শিকার হয়েছে। ক্রমবর্ধমান এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি ধ্বংসের কারণে এরই মধ্যে বন্যপ্রাণীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরো প্রায় ৩০ প্রজাতির অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে রয়েছে, যা ক্রমে বনকেন্দ্রিক জীবনচক্র ও বাস্তুসংস্থানের জন্য অশনিসংকেত।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্যারিস চুক্তি লঙ্ঘন করে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের সন্নিকটে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অন্যতম নিয়ামক এ প্রাকৃতিক রক্ষাকবচকে স্থায়ীভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। অথচ সুন্দরবন যেমন সমৃদ্ধ জীবজগৎ ধারণ করে প্রাণ ও প্রকৃতির রসদ জোগাচ্ছে, তেমনি সাম্প্রতিককালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ফনীসহ সর্বশেষ আম্পানের তীব্রতা থেকে উপকূলের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা করেছে।

শুধু তা-ই নয়, বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি দেশের পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ লঙ্ঘন করে নির্বিচারে শিল্পায়ন ও বিভিন্ন শিল্প বিশেষ করে ডায়িং কারখানা ও ট্যানারিগুলোর শিল্পবর্জ্য নদনদী, খালবিলসহ প্রাকৃতিক উন্মুক্ত জলাধারগুলোয় নিক্ষেপণের মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক জলাধার বা জলজ জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে বিনষ্ট করা হচ্ছে। জলাধারগুলো অবৈধ দখল এবং সংলগ্ন স্থানে অপরিকল্পিত বসতি ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসসহ জলজ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনৈতিক উপায়ে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাধার (নদনদী, খালবিল, হাওর এবং অন্যান্য জলাশয়) বেদখল করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাহাজ ভাঙাসহ সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ শিল্প থেকে নিক্ষিপ্ত বর্জ্য ও প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক মাছ ও সমুদ্রের অভ্যন্তরের জলজজীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বন ও জলজ বাস্তুসংস্থানের ওপর অভিঘাতের সঙ্গে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং বাংলাদেশের রাজধানী দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তালিকায় উঠে এসেছে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং অসংখ্য মানুষ ফুসফুস ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বায়ুদূষণের ফলে পশুপাখির খাদ্য সংগ্রহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পাশাপাশি কীটনাশকসহ অজৈব সারের যথেচ্ছ ব্যবহারে মাটির উর্বরা শক্তি রক্ষাকারী প্রাকৃতিক অণুজীবসহ শস্য ও সবজির ওপর নির্ভরশীল খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন পাখি ও প্রাণী আশঙ্কাজনক হারে মরার কারণে মানুষের জীবন ও টেকসই জীবিকার ওপর হুমকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে দেশের বনজসম্পদ সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও বনজসম্পদের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। আর বাংলাদেশে রয়েছে বনায়নের বিপুল সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য যা যা করণীয় তা হলো- ১. দেশীয় অর্থকরী বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে; ২. বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে বীজ ও চারা; ৩. নদীর কিনারা ও সড়কের দুপাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে; ৪. বনভূমির গাছকাটা রোধ করতে হবে; ৫. অপরিণত গাছকাটা বন্ধ করতে হবে; ৬. প্রয়োজনে গাছ কাটা হলে সে অঞ্চলে নতুন চারাগাছ লাগাতে হবে; ৭. বনভূমি থেকে কাঠের চোরাচালান বন্ধ করতে হবে; ৮. গ্রামবাসীকে খাদ্য ফল জ্বালানি ইত্যাদি আহরণ উপযোগী বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরোপণ করতে হবে; ৯. সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় অংশগ্রহণকারীদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে; ১০. সামাজিক বনায়ন সম্পর্কিত সব বিষয় তদারকি করার জন্যে ওয়ার্ড মেম্বারের নেতৃত্বে শিক্ষক, সমাজকর্মী, মসজিদের ইমাম প্রমুখের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বনায়নের জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে বিভিন্ন মেয়াদে জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে চারা। তবে বাংলাদেশের সরকারি বনভূমিতে যে বনায়ন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে তা পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর। যেমন-দেশীয় প্রজাতির গাছ নিশ্চিহ্ন করে সেখানে রাবার, সেগুন, আকাশিয়া প্রভৃতির শিল্প বন তৈরি করা হচ্ছে। বিদেশি প্রজাতির গাছের সঙ্গে ক্ষতিকর অনেক কীটপতঙ্গ আসে। এ ধরনের গাছ মাটি থেকে পানি শোষণ করে নেয় বলে আশপাশের জমিতে পানির পরিমাণও কমে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম, মধুপুর প্রভৃতি পার্বত্য এলাকায় রাবার চাষ এবং বাণিজ্যিক ও শিল্প বনায়নের কারণে অধিক মাত্রায় মাটিক্ষয় ও পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এসব অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীরা বনাঞ্চল থেকে তাদের প্রয়োজনীয় শাকসবজি, ফলমূল ও নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করতে পারছে না। অনেকক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রাণীর অস্তিত্ব ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। গাছ প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ও বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আবহাওয়া বিশুদ্ধ রাখে। মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির ক্ষয়রোধ করে। অর্থাৎ মানুষের বসবাস উপযোগী ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী বৃক্ষেরই অবদান। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে বাঁচানো ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর বনায়নের জন্যে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পরিকল্পিত ও সঠিক বনায়নের মাধ্যমেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads