• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আত্মহত্যা : নতুন আতঙ্ক

  • প্রকাশিত ০৭ জানুয়ারি ২০২১

আরোশি আঁখি

 

 

 

কোভিড-১৯-এর সাথে যুক্ত হলো নতুন আতঙ্ক হিসেবে আত্মহত্যা বা আত্মহনন, যাকে ইংরেজিতে আমরা সুইসাইড বলে থাকি। যখন একজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয় অর্থাৎ নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটাতে আত্মহনন করে তাকে আত্মহত্যা বলা হয়।  ল্যাটিন ভাষায়  সুই সেই ডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটির আগমন, যার অর্থ নিজেকে হত্যা করা। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। নারীদের তুলনায়  পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিন থেকে চারগুণ বেশি। তবে বহির্বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এ বিষয়ে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় লাখে ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে, যেখানে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। দিন দিন বিভিন্ন বয়সি মানুষের মধ্য আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে ৫৬টি দেশের মধ্যে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেশে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। যার মধ্যে ৫৩% পুরুষ এবং ৩৯% নারী আত্মঘাতী ছিল। সারা দেশে ১৫.২ মিনিটে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে এবং প্রতি ৩৮ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

আত্মহত্যার এই হার মহামারীতে অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষাঙ্গন, বন্ধু-বান্ধবীসহ চলমান জীবনযাপন থেকে দূরে থেকে মানুষের মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে জীবনের সকল সমস্যা থেকে বাঁচতে মানুষ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।  প্রায় প্রতিদিন চোখে পড়ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদ। আত্মহত‌্যার প্রবণতা কি আসলেই একটি রোগ? এতদিন বলা হতো, আত্মহত‌্যা একটা লক্ষণ বটে এটা  কোনো অসুখ নয়। কিন্তু এখন এই ধারণায় বদল এসেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমেরিকার ডেভিড শিহান নানা যুক্তি প্রদান করে  উদাহরণ তুলে ধরে আত্মহত‌্যাকে অসুখ বলেই দাবি করছেন। তার এই দাবিকে মান‌্যতা দিয়েছেন বিখ‌্যাত সাইকিয়াট্রিস্টরাও। তাদের মতে, আত্মহত‌্যা বা তার চেষ্টা বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, একে শুধু ডিপ্রেশনের একটি লক্ষণ বলা ভুল। আত্মহত্যার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে জানা যায়। ডিপ্রেশনের কারণে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে তরুণ-তরুণীরা। অর্থাৎ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ তাদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে ডিপ্রেশনকে দায়ী করা হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রায় তিনশ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লাখ) ডিপ্রেশনের রোগী আছে। প্রতি ৫ জনের একজন মানুষ কোনো না কোনো কারণে ডিপ্রেশনের শিকার। আত্মহত‌্যার ইচ্ছার প্রথম ধাপের লক্ষণ হলো, যেখানে রোগী ভাবেন, আমি নিজে সক্রিয় হয়ে কিছু করব না, মৃত্যু নিজের থেকে চলে এলে ভালো হয়। দ্বিতীয় ধাপে রোগী চিন্তা করে নেন তিনি কীভাবে মরতে চান। কিংবা কীভাবে মরলে ভালো হয় এবং সেটা নিয়ে গবেষণা করা, পরিকল্পনা করা। তারপর অ‌্যাকশন ও চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই ধরনের আত্মহত‌্যায় রোগী বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখেন। কোন জায়গায় কখন সুইসাইড করবেন, সব ঠিক করা থাকে। এমনকি সেই স্থানে ওই সময় গিয়ে একাধিকবার দেখেও আসেন। আর এক ধরনের হয়, যেখানে হঠাৎ কোনো আবেগ থেকে আচমকা আত্মহ‌ত‌্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। একে ইম্পালসিভ সুইসাইড বলে। এ ধরনের লক্ষণকে এখন ডিসঅর্ডার বলে ধরা হয়। করোনা মহামারীর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার হার। এর পেছনে আমি মনে করি মানুষে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্ক হ্রাস পাওয়া দায়ী। দারিদ্র্য, একাকিত্ব, বেকারত্ব, ক্যারিয়ার বিষয়ক অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন কারণ দায়ী। আসলেই সবাই পরিস্থিতির শিকার মাত্র। এ সময় যার যার জায়গা হতে নিজেকে মোটিভেট করতে হবে।  নিজের জীবনের জন্যই নিজেকে বাঁচতে হবে। আত্মহত্যা নিজেই একটা বিজ্ঞাপন—কথাটা অদ্ভুত শোনা গেল,  তাই না? তবে কথাটার প্রমাণ ইতঃপূর্বে অনেকবার মিলেছে।  ক্রমশ যেন তার প্রতিক্রিয়া বাড়ছে। ঢাবির ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে কেবল এই মহামারীতে। তা ছাড়া রাবি শিক্ষার্থী, ইবি শিক্ষার্থীসহ একের পর এক শোনা যাচ্ছে আত্মহত্যার মিছিল। আসলে আত্মহত্যা শব্দটা নিজে থেকেই মানুষের মধ্য নিজের অস্তিত্বের অগ্রসর ঘটায়। তাই যতটা সম্ভব এই ধরনের সংবাদ কম প্রচার করা উচিত বলে আমার মনে হয়। তার মানে এই নয় যে সতর্ক করা যাবে না বা সংবাদ প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকবে। তবে অবশ্যই এই প্রচার যাতে প্রসার না ঘটায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মানসিক অবসাদগ্রস্ত মানুষ এই ধররে সংবাদকে মোটিভেশন হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে নিজের জীবন নাশের মাধ্যম তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার প্রিয়জনদের প্রতি অভিমান করে তাদের নিজের অবস্থান বোঝাতে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।

এখনই সময় আত্মহত্যা শব্দটাকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। মানুষের সাথে মানুষের সখ্য গড়ে তুলতে হবে। কেবল কারো সমস্যা শোনার বদলে নিজের ঘটনা শোনাতে ব্যাস্ত না হয়ে মনোযোগ দিয়ে বিপরীত পাশের মানুষের  সমস্যাগুলো শুনুন, তাকে সময় দিন এবং তার মনোবল বৃদ্ধি করতে তার সাথে বন্ধুত্ব চলমানতা বজায় রাখুন। সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে। দারিদ্র্যের হার কমাতে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। বেকারত্ব হ্রাস করতে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল প্রতিষ্ঠানে হাতেকলমে দীক্ষা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।  আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এগিয়ে আসতে হবে।  সুন্দর সমাজ পারে এই ধরনের আতঙ্ক হতে মুক্তি দিতে। তাই সমাজকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে অনতিবিলম্বে। এছাড়া বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বাড়িয়ে তুলছে আত্মহত্যার প্রবণতা। সব বয়সের মানুষ ইন্টারনেটের এই জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে অল্পবয়সে ভুল পথ বেছে নিচ্ছে এবং সমাজ ও পরিবার থেকে মুখ লুকাতে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। 

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads