• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

উন্নয়নশীল বাংলাদেশ : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

  • প্রকাশিত ১৩ মার্চ ২০২১

জি কে সাদিক

 

 

 

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ও উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আমাদের জন্য বড় ধরনের একটা অর্জন। এ অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেসব দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ পেয়েছে তার মধ্যে খনিজসম্পদনির্ভর দেশ রয়েছে এবং পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্র রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। তাই বাংলাদেশের জন্য যেসব ঝুঁকি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো হলো-১. বেসরকারি বিনিয়োগে ক্রমবর্ধমান অবনতি, ২. বেকার সমস্যা বৃদ্ধি এবং ৩. অনুদান ও স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তি কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগে হার কমছে। বিবিএস-এর তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ০২ শতাংশে নেমে আসে। গত ৫ বছরে তা আরো কমে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে আসে ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশে। অদ্যাবধি এই ভাটা থামছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুঁজি সহজলভ্যতার সমস্যা, অবকাঠামো উন্নয়ন সমস্যা, সুশাসনের অভাব, কাঁচামালের ঘাটতি। এসব কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ খাত অনেকটা ভাটার সম্মুখীন। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.২ শতাংশ থেকে করোনা মহামারীর কারণে নামিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জিডিপির ২৪ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন। অর্থাৎ চলতি বছরে বেসরকারি খাতে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে প্রবৃদ্ধি না বাড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই বেসরকারি বিনিয়োগ খাতে চলমান ভাটা ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ স্বল্পোন্নত দেশের বিনিয়োগ আর উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগ সুবিধায় অনেক তারতম্য আছে। স্বল্পোন্নত দেশের চাইতে উন্নয়নশীল দেশে করের পরিমাণ বাড়ে যেটা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টিতে বাধার কারণ হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এর অন্যতম হলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাঁচা মালের জোগান সমস্যা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা ও শ্রম আইনের বাস্তবায়ন না থাকায় শ্রমিক আন্দোলনের সমস্যা। বর্তমানে আমাদের রপ্তানি শিল্পের প্রধান হলো গার্মেন্ট শিল্প। কিন্তু এই শিল্প সম্প্রতি নানা প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি বয়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বর্তমান কোভিড-১৯-এর কারণে বিদেশি অর্ডার ক্রমাগত নিম্নমুখী হওয়া।

 

২.

দ্বিতীয় যে বিষয় সেটা হলো বেকার সমস্যা। এটা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি সাড়ে চার কোটি কর্মক্ষম মানুষ স্বীকৃত শ্রমশক্তির বাইরে আছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নারী। আর বাকি ১ কোটি ২০ লাখ তরুণ যারা পড়ালেখাও করছে না, আবার শ্রম বা প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াতেও নেই। প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, দেশে ছদ্মবেকারের সংখ্যা ৬৬ লাখ। তাদের মধ্যে চাকরি খুঁজেও পায়নি এমন বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। ১৪ লাখ মানুষ খণ্ডকালীন চাকরি করছে, যাদের চাকরির কোনো ধরনের নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তারা চাকরির যোগ্য। দেশের বেকার সংখ্যার এই ক্রমবর্ধমান চিত্র ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ স্বীকৃতির পর আমাদের অর্থনীতির জন্য দ্বিতীয় গলার কাঁটা। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরিমাণে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজন সেটা আশানুরূপ হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমছে। ২০১৬ সালে কৃষি খাতে নিয়োজিত ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ, বছর বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখে। এর কারণ হলো প্রতিকূল প্রকৃতিক পরিবেশ, এ খাতে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। অন্যদিকে বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি থমকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য আগের মতো শ্রমশক্তি রপ্তানি হচ্ছে না। করোনা একে আরো দীর্ঘায়িত করে তুলেছে। তাই প্রবাসী আয়ের পরিমাণও কমে যাবে স্বাভাবিকভাবেই। অন্যদিকে দেশের ভেতরেও উদ্যোক্তা নেই। আর উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ প্রণোদনা প্রয়োজন তা খুবই অপ্রতুল। তাই বেকার সমস্যার সমাধান একটা বড় ধরনের ‘ফ্যাক্টর’।

 

৩.

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়-এক. মাথাপিছু আয়, দুই. মানবসম্পদ সূচক এবং তিন. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। বাংলাদেশ এই তিনটি ক্ষেত্রেই বেশ সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু কথা হলো, যখন একটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ পায় তখন বৈদেশিক অনুদান ও স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তি কমে যায়। সে সময় বেশি সুদে ঋণ সুবিধা নিতে হয়। বাংলাদেশ আশা করা যায় ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সর্বতো অর্থে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও আরো দুই বছর স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধাগুলো পাবে। কিন্তু তারপরে অনুদান ও কম সুদে ঋণ সুবিধা আর পাবে না। তাই নতুন একটা ঝুঁকি আমাদের সামনে আসছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) মাধ্যমে বিনামূল্যে ঋণ দিয়ে থাকে বিশ্বব্যাংক। যার সার্ভিস চার্জ মাত্র দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৮ বছর রেয়াত করাসহ ৩৮ বছরে এই ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২১৫ ডলার হলে এই ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশ আর এই সুবিধা পাবে না। সে ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সুবিধায় ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেপলমেন্ট (আইবিআরডি) তহবিল থেকে ঋণ নিতে হয়। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে বৈদেশিক অনুদান ও স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা ছিল তা আর থাকবে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগী হতে হবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।

 

৪.

অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ এখনো দরিদ্র। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রয়েছে প্রতিবন্ধকতা, আঠার মতো লেগে আছে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ক্রমবর্ধমান। নাগরিক সেবাগুলোও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। নগর বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা এখনো বাস্তবায়নে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। নারী-পুরুষের আয় বৈষম্যও অনেক। বিবিএস’র তথ্য মতে, দেশের ৬৭ শতাংশ নারীর কাজই উপেক্ষিত। অথচ বর্তমানে দেশে নারী-পুরুষে অনুপাত ৫১:৪৯। নারীরা শ্রম দিচ্ছে; কিন্তু তা আমাদের জিডিপিতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার হলেও সব নাগরিকের আয় এক নয়। এটা গড় হিসেবে মাত্র। তাই এ বিষয়গুলো আমাদের অর্থনীতিকে আগামী দিনে প্রভাবিত করবে। অন্যদিকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে থাকবে আমাদের অর্থনীতির গতিবিধি। বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর আদায় বাড়ানো, বৈষম্য দূর ও দারিদ্র্য বিমোচন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে উন্নয়নশীল পর্যায় অতিক্রম করে আমাদের বিনির্মাণ করতে হবে উন্নত বাংলাদেশ। তবে আশার কথা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়শীল দেশের আনুষ্ঠানিক মর্যাদা ঘোষণা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের বিষয়। উপরন্তু নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনেই আছে। এই সুখবর আমাদের আশান্বিত করে তুলেছে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads