• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ক্লাস বিমুখে ফল নিম্নমুখী

প্রায় সব বোর্ডেই এবার ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে

সংরক্ষিত ছবি

শিক্ষা

ক্লাস বিমুখে ফল নিম্নমুখী

গত ৫ বছরের মধ্যে এটাই খারাপ ফল

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ২০ জুলাই ২০১৮

চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাস এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার দুটোই কমেছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীর কম উপস্থিতি, ক্লাসে না থাকলেও ডিসকলেজিয়েট এবং ননকলেজিয়েট না করা, কলেজের সময় বাইরে কোচিং ক্লাস করানো, ইংরেজির দুর্বলতাসহ কঠিন বিষয়ে ভীতি, বেশিরভাগ কলেজে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক কম থাকায় এ পরিস্থিতি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা আরো মনে করেন, প্রতিষ্ঠান যত শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে তার ৮০ শতাংশ চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানোর বাধ্যবাধকতা, নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস না করলেও বিভিন্ন চাপে ফেল করা শিক্ষার্থীকে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া এবং অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি ফেলের কারণে ফল নিম্নমুখী হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এতে দেখা গেছে, পাসের হার গত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ কমে হয়েছে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। একই সঙ্গে ৮ হাজার ৭০৭ জন কমে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিকের গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটাই সর্বনিম্ন ফলাফল।

প্রকাশিত ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যশোর বোর্ডে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং সিলেট বোর্ডে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই দুই বোর্ডের পাসের হার কমে যাওয়ায় সার্বিক পাসের হারে ধাক্কা লেগেছে। কেন এমনটি হয়েছে তা খতিয়ে দেখাসহ পরবর্তী পরীক্ষাগুলো কীভাবে নেওয়া হবে তার রূপরেখা নিয়ে গতকালই বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব। এ সময় সচিব বোর্ড চেয়ারম্যানদের বলেন, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। এবারের পরীক্ষায় কয়েকটি বোর্ডের ফলাফল কেন খারাপ হলো তা বিশ্লেষণ করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।

তবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এবারের পরীক্ষা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি কোনো গুজবও কেউ রটাতে পারেনি। বলা যায়, এবারের পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাসের হার নিম্নমুখী স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় সংখ্যায় আমরা এগিয়ে আছি। এখন আমরা গুণগত মানের দিকটায় গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা ক্লাস নেওয়া ও ভালোভাবে পরীক্ষা নেওয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ঠিকভাবে যেন খাতা দেখা হয়, সেদিকে নজর দিচ্ছি। যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। আমরা কাউকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমাতেও বলি না। আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করছি সঠিক মূল্যায়নে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ফলাফল কেন খারাপ হলো আমরা দেখব। সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোও দেখবে, মূল্যায়ন করবে। আমরা সমস্যা চিহ্নিত করব। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্বহীন মনে করি না। তিনি বলেন, যখন বেশি পাস করেছে, তখন সবাই বিস্মিত হয়েছে। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি। আগে বেশি পাস করত, বলা হতো ভালোভাবে খাতা দেখা হয়নি। আবার এখন কম পাস করেছে, এখন বলা হচ্ছে পাসের হার কমে গেল কেন? বেশি পাস করলেও অপরাধ, কম পাস করলেও অপরাধ। আসলে আমরা এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে খাতা দেখার মান ঠিক রাখতে গিয়ে পাসের সংখ্যা কিছুটা কম হবে এটা স্বাভাবিক।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব বোর্ডেই এবার ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে। ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে যশোর বোর্ড। এ বোর্েড খারাপ করেছে ৩৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি বাংলা ও পৌরনীতির মতো সহজ বিষয়েও শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরিশাল বোর্ডে বাংলায় ফেল করেছে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ, যশোর ও সিলেট বোর্ডে ৭ এবং ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে ৭ দশমিক ১৭, যশোরে ১৪, চট্টগ্রামে ১৭, বরিশালে ১৩, দিনাজপুরে ১২ এবং সিলেটে ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। পদার্থবিজ্ঞানে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও দিনাজপুরে প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী, পৌরনীতির মতো সহজ বিষয়ে চট্টগ্রামে ১৪ শতাংশ এবং সিলেট বোর্ডে প্রায় ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করায় সার্বিক পাসের হারে ধাক্কা লেগেছে।

জানতে চাইলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কবির আহমদ বলেছেন, এবার ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি অকৃতকার্য হয়েছে। এ কারণে সামগ্রিক ফলাফলে এর প্রভাব পড়েছে। তবে এবার পাসের হার কমলেও মেধাবীদের সংখ্যা বেড়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানোই এখন শিক্ষা বোর্ডের টার্গেট বলে তিনি মনে করেন।

ফলাফলের চিত্র তুলে ধরে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র জানান, এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এজন্য পাসের হার কিছুটা কমেছে। তবে ভালো শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেছে। আর দেশের প্রায় সব বোর্ডেই এবার ইংরেজির ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে। যশোর বোর্ডে এবার ইংরেজিতেই ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হয়েছে। এ ছাড়া মানবিকেও পাসের হার কমেছে।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, এবার কোনো প্রশ্ন আউট হয়নি। এর ফলে যাদের প্রস্তুতি ঠিক ছিল না, তারাই খারাপ করেছে। তা ছাড়া বাংলা, আইসিটিসহ অনেক বিষয়েই অনেকে জিপিএ-৫ পায়নি। কোনো কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কঠিন ছিল। আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকরকম প্যানিক ছিল। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই ভালো করে পড়তে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। তার মতে, শিক্ষার্থীরা বই পড়ে না, নোটের ওপর নির্ভরশীল বেশি হওয়ার কারণেই ফেল করেছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী জিমি আক্তার বলেছেন, এবার অনেকেরই ফল খারাপ হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরীক্ষার রুটিনে কোনো গ্যাপ ছিল না, আমাদের টানা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশ্নপত্রও তুলনামূলক কঠিন ছিল।

জানতে চাইলে হবিগঞ্জের বাহুবলের আলিফ সোবহান চৌধুরী কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সাদিকুর রহমান বলেন, পরীক্ষার নম্বর বিভাজন পদ্ধতির কারণেও এবার উচ্চ মাধ্যমিকে কাঙ্ক্ষিত ফল হয়নি। তিনি বলেন, অনেক ভালো ভালো শিক্ষার্থীও ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারেনি। আগে যে সময়ে ৬টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে হতো এবার একই সময়ে ৭টি লিখতে হয়েছে। এতে বহু শিক্ষার্থী ধরা খেয়েছে।

সিলেটের বালাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক অবিনাশ আচার্য্য বলেছেন, গ্রাম ও শহরতলির অধিকাংশ কলেজেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক নেই। শিক্ষার্থীদের বিশেষ একটি অংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকে না। পারিপার্শ্বিক নানা চাপে নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণদেরও পাবলিক পরীক্ষার সুযোগ দিতে হয়। মানবিক বিভাগের বহু শিক্ষার্থী ইংরেজি আর আইসিটিতে ভালো করতে পারে না। এসব কারণে পাসের হার কমে।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হারের দিক থেকে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। পাসের হারের দিক দিয়ে মেয়েরা কয়েক বছর ধরেই ভালো করছে। কিন্তু এবার তারা ব্যবধান আরো বাড়িয়েছে। এবার ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাসের হার ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। অবশ্য ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্ররা এগিয়ে আছে।

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার অংশগ্রহণকারী মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৭ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ জন। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের পাসের হার ৬৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৬৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ১০ বোর্ডের অধীনে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৫ হাজার ৫৮১ এবং ছাত্রী ১৩ হাজার ৬৮১ জন। অর্থাৎ এখানে ছাত্ররা এগিয়ে। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শুধু পাসের হারে মেয়েরা আরো বেশি ভালো করেছে। এইচএসসিতে গড় পাসের হার ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্রীদের পাসের হার ৬৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৬০ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে মেয়েরা ফলের পাশাপাশি সংখ্যায় ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে আগেই। উচ্চ মাধ্যমিকে যে সংখ্যাগত ব্যবধান ছিল, সেটাও এবার কমিয়ে এনেছে মেয়েরা। আর এতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আপ্লুত। বলেছেন, নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের যে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা সেটিরই বাস্তবায়ন হচ্ছে। ‘মাইয়ারাও স্কুলে যাবে’- এমন কথা এখন আর কাউকে বলতে হবে না। মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি, বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা আর পড়াশোনা শেষে চাকরির সুযোগ সমাজকেও নারীশিক্ষার দিকে ধাবিত করেছে।

বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতেও গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে এ বছর পাসের হার ৮৬ দশমিক ১৫, গত বছর এই হার ছিল ৯২ দশমিক ১৭, রসায়নে এ বছর পাসের হার ৯৪ দশমিক ৩৫, গত বছর এই হার ছিল ৯৭ দশমিক ৫৮, উচ্চতর গণিতে এ বছর পাসের হার ৮৭ দশমিক ৫, গত বছর এই হার ছিল ৯৫ দশমিক ৮৯, জীববিজ্ঞান বিষয়ে এ বছর পাসের হার ৯৪ দশমিক ৭, যা গত বছর ছিল ৯৬ দশমিক ৯৩। আইসিটিতে এ বছর পাসের হার ৮২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

বিজ্ঞানে ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা ভালো করে দেখে কারণ খুঁজে বের করব। আগে গণিতে, ইংরেজিতে একজনও পাস করত না। আমরা আলাদা শিক্ষক দিয়ে আলাদা ক্লাস করিয়েছি। ধীরে ধীরে দুর্বল শিক্ষার্থীরা এর সুফল পেয়েছে। তারা পাস করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads