• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
শিক্ষক বড় না মন্ত্রী বড়?

লোগো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

শিক্ষা

শিক্ষকের সন্তান যেতে পারবে না কেজিতে

শিক্ষক বড় না মন্ত্রী বড়?

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

পূর্ণ মন্ত্রী না দিয়ে কুড়িগ্রামের একজন সংসদ সদস্য মো. জাকির হোসেনকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে নাক কুঁচকে ছিল অনেকেরই। অখ্যাত একজন রাজনীতিককে প্রাথমিক শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি- এমন মন্তব্যও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী সকলের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে চিনিয়ে দিলেন। বোঝালেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অপাত্রে ঘি ঢালেননি’।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিডিও কনফারেন্স করা হয় ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ, ধামরাই, দোহার ও সাভার উপজেলায়। কনফারেন্সের শুরুতে সচিব আকরাম-আল-হোসেন প্রাথমিক শিক্ষায় কী কী করতে চান তার একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেন। এরপরেই প্রতিমন্ত্রী বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রায় আধাঘণ্টা বক্তব্য দেন। প্রতিমন্ত্রীর বক্তৃতায় প্রাথমিক শিক্ষার আদ্যোপান্ত বলে যাওয়া দেখে কর্মকর্তাদের মধ্যেই অনেকেই চমকে ওঠেন। নয়া মন্ত্রী কিছু জানেন না বলে যে ধারণা ছিল, বক্তৃতার পর তাদের সেই ঘোর অনায়াসে কেটে যায়।

বক্তৃতার শুরুতেই প্রতিমন্ত্রী বলেন, শিক্ষক বড় না মন্ত্রী বড়, কে বড়? অবশ্যই শিক্ষকরা। শিক্ষকরা জাতিকে ধ্বংসও করতে পারে আবার গঠনও করতে পারে। শিক্ষকরা সম্মানিত। আমি এখনো আমার শিক্ষককে সামনে পেলে কদমবুসি করি। তিনি বলেন, মানছি শিক্ষকদের মধ্যে সমস্যা আছে, বেতনের বৈষম্য রয়েছে। আরো ছোটখাটো বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। অবশ্যই আপনাদেরটা সমাধান করা হবে। তবে জাতি গঠনের কারিগর আপনারাই। স্কুলে শিশুদের সঙ্গে মা-বাবার ভূমিকায় আপনাদেরও আসতে হবে। কারণ আপনারাই শিশুদের দ্বিতীয় মা-বাবা। এজন্য একটু ভালো পড়াশুনা করাতে হবে। মানসম্মত শিক্ষাটা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আমি আবারো বলছি আপনাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। আমার বাড়িতেই ১৫-২০ জন শিক্ষক আছেন। কাজেই তাদের মাধ্যমে আপনাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানি। তিনি বলেন, হালালভাবে দায়িত্বটা পালন করুন। আমরা হারাম খাব না। বেতন নেব অথচ শ্রম দেব না তা হয় না। প্রত্যেক শিক্ষককে সকাল নয় টায় স্কুলে আসতে হবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে হবে। শিক্ষার মান সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব সকলের। আমরা একই পরিবারের সদস্য। সঠিক সময়ে স্কুলে আসুন।

তিনি মাঠ পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলোর দুর্নীতির কথাও তুলে ধরেছেন বক্তৃতায়। তিনি বলেন, কোনো শিক্ষা কর্মকর্তা শিক্ষকদের হয়রানি কিংবা অপমান করলে আমি ক্ষমা করব না। আবার কোনো শিক্ষক যদি ‘টিইও’র (থানা শিক্ষা অফিসার) বগলে থাকেন তাহলেও শাস্তি হবে ওই শিক্ষকের। এ সময় সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান, শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি হওয়ার বিষয়ে কী হবে? জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কেজি স্কুলে বেশি বই পড়ানোর বিষয়েও মন্তব্য করে তিনি বলেন, ওখানে বাচ্চাদের অনেক বই পড়তে হয়। তা আমরা জানি। প্রাথমিকে যদি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায় তাহলে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা কেজি স্কুলে যাবে না। তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, আপনার এমনভাবে পড়াশুনা করান যাতে শিক্ষার্থীরা কেজি স্কুল ছেড়ে প্রাথমিকে ভর্তি হয়। এর আগে সচিব আকরাম-আল-হোসেন বক্তৃতা দেন।

  

একই পাঠ প্রাথমিকে

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সপ্তাহের কোনদিন, কোন বিষয়ের কতটুকু অংশ পড়ানো হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অনুসরণ করবে সেই ‘পাঠ পরিকল্পনা’ বা ‘লেসন প্ল্যান’। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) এই পাঠ পরিকল্পনার একটি খসড়া এরই মধ্যে তৈরি করেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ওই লেসন প্ল্যান চূড়ান্ত করে প্রত্যেক স্কুলে পাঠিয়ে দেব। বাংলাদেশের প্রত্যেক স্কুলের লেসন প্ল্যান হবে এক রকম। বিষয়টির ব্যাখ্যায় সচিব বলেন, ঢাকার নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে পাঠদান হবে, পঞ্চগড়ের একটা প্রত্যন্ত স্কুলের বাংলায় সেই একই পাঠ হবে। কর্মকর্তারা মনিটরিং করবে স্কুলে গিয়ে ওই টিচারের কোনটি পড়ানোর কথা ছিল, সে কোথায় পড়াচ্ছে। একটা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে করাপশনকে জিরো করার জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছি।

শিক্ষকের সন্তান যেতে পারবে না কেজি স্কুলে

গণশিক্ষা সচিব বলেন, আমাদের সার্কুলার আছে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াতে হবে। আমরা সেটা আবারো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেব। অর্থাৎ আমরা আবার নিশ্চিত করব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিচারদের ছেলেমেয়েরা কিন্ডারগার্টেনে পড়তে পারবে না। এটা কঠিন হলেও আমরা করব। এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা কঠিন। তবে আমরা এমন সিস্টেম চালু করতে চাই, যেন কেজির বাচ্চারা আমাদের এখানে আসে। ভিডি কনফারেন্সে ওপারের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি লক্ষ করছি বাচ্চারা প্রাইমারিতে পড়ে না খালি কেজি স্কুলের দিকে যায়। এটার হেতু কী? কেজি স্কুলের মাস্টাররা তো বেতনও পান না, আপনারা যতটা পান। আমার দাদা প্রাইমারির শিক্ষক ছিলেন, ভাঙা সাইকেল, বেড়ার সঙ্গে লাগানো থাকত। সব সাইকেল নিতাম, ওই মাস্টারের সাইকেল নিতাম না, কিছু দূর গেলে চেইন পড়ে যেত। আজকে আপনাদের সেই ভাঙা সাইকেল নাই। এখন সবার মোটরসাইকেল। ‘ভবিষ্যতে যেন কেজি স্কুলের ছেলেরা আপনার স্কুলে যেতে চায়, আপনার স্কুলের ছেলেরা কেজিতে না যায়...।’ এ সময় কনফারেন্সের ওপাশ থেকে একজন বলেন, এই ধারা শুরু হয়ে গেছে। জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ধন্যবাদ আপনাদেরকে। আর যে স্কুল এটা করতে পারবেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের পুরস্কৃত করব। এর মাধ্যমেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় রাশ টানার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জার্মান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ফ্রো এব্ল-এর উদ্যোগে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রথম চালু হয় জার্মানিতে। বাংলাদেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থা জনপ্রিয় হতে শুরু করে ৯০ দশক থেকে। আর চলতি শতকে শহরাঞ্চলে শিশুদের একটি বড় অংশ সরকারি প্রাথমিকের বদলে কিন্ডারগার্টেনকেই বেছে নিচ্ছে। বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজারের মতো। আর কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা অন্তত ৭০ হাজার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম ইকবাল বাহার চৌধুরী। তিনি জানান, প্রতি বছরই স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে এবং এই মুহূর্তে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। কিন্ডারগার্টেন এখন ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা শহর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও। আর এতে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য সেটি পূরণ হচ্ছে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads