• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
আরেকটি স্বপ্ন সফলের দ্বারপ্রান্তে দেশ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

আরেকটি স্বপ্ন সফলের দ্বারপ্রান্তে দেশ

  • প্রকাশিত ২৭ জুন ২০১৯

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় দেশের প্রথম লোহার খনির সন্ধান মিলেছে। উপজেলার ইসবপুর গ্রামে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) এ খনির সন্ধান পেয়েছে। জিএসবি জানিয়েছে, খনিটিতে উন্নত মানের লোহার আকরিক (ম্যাগনেটাইট) রয়েছে। ইতঃপূর্বে সমুদ্র জয়ের পর মহাকাশে নতুন ঠিকানা স্থাপনসহ নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনায় সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশ ও জাতির জন্য এক অসামান্য সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি গৌরবের এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বাঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর হয়েছে সফল মহাকাশ ও সমুদ্র জয়ের ওই মিশনের মাধ্যমে।

দেশের প্রথম লোহার খনির আবিষ্কারের খবরে লোহার খনির সন্ধানে নিয়োজিত বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি দেশবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন। লোহার খনি উত্তোলনে আমরা সফল হলে আরেকটি ইতিহাস ও স্বপ্ন সত্যি হবে! মহাকাশের পর এবার ভূগর্ভের সহস্র ফুট গভীরের পাতাল জয়ের ‘মহাকাব্য’ লেখার পালা শুরু হবে। প্রথম লোহার উত্তোলন, অবলোকনও হবে গোটা জাতির জীবনে এক অনন্য মাহেন্দ্রক্ষণ ও বহুল প্রতীক্ষিত গৌরবের অনুভূতি।

দীর্ঘ দুই মাস ধরে কূপ খনন করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর গত ১৮ জুন এ তথ্য জানান জিএসবির সংশ্লিষ্টরা। লোহার পাশাপাশি খনিটিতে মূল্যবান কপার, নিকেল ও ক্রোমিয়ামেরও উপস্থিতি রয়েছে বলে জানা যায়। গত ২৬ মে জিএসবির মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান চৌধুরীসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা ইসবপুর পরিদর্শন করেন। লোহার খনি আবিষ্কার হতে চলেছে, এমন ইঙ্গিত ওই সময়ই মিলেছিল। জিএসবির কর্মকর্তারা জানান, ভূগর্ভের ১ হাজার ৩০০ ফুট থেকে ১ হাজার ৬৫০ ফুটের মধ্যে লোহার একটি স্তর পাওয়া গেছে। খনিটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার। খনিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন লোহাসহ অন্যান্য মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। হাকিমপুর উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইসবপুর গ্রাম। এই গ্রামের ৫০ শতক জমিতে খনিজ পদার্থের সন্ধানে কূপ খনন করেছে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর।

খননকাজে নিয়োজিত জিএসবির সংশ্লিষ্টরা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে লোহার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর অধিকাংশের লোহার গুণগত মান ৫০ শতাংশের নিচে। তবে এ খনিতে লোহার মান ৬০ শতাংশের উপরে। জয়পুরহাট ও ঢাকায় জিএসবির পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ২০১৩ সালে একই এলাকার মুশিদপুরে কূপ খনন করে খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছিল। সেই গবেষণার সূত্র ধরে ৬ বছর পর চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল থেকে ইসবপুরে কূপ খনন শুরু হয়। দিনাজপুরে লোহার খনির পাশে নতুন করে দীঘিপাড়া কয়লাখনির কাজও চলছে। এসব খনি থেকে পুরোদমে উত্তোলন শুরু হলে উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ঘটবে এখানকার মানুষের।

আকরিক লোহা বা ‘আয়রন ওর’ সাধারণত ওপেনকাস্ট মাইন (যে মাইন উপরের মাটি সরিয়ে গঠিত) থেকে আহরিত হয়। আন্ডারগ্রাউন্ড মাইন যা ১ হাজার ৬০০ ফুট গভীর হবে, তেমন মাইন থেকে আকরিক লোহা উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে ‘ভায়াবল’ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশ্ববাজারে লোহা ও স্টিল ইন্ডাস্ট্রির কঠিন সময় যাচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে ওভার প্রোডাকশনে কিছু সমস্যারও বিষয় রয়েছে। কাজেই পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। এ ধরনের সংবাদে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা আবশ্যক। যা হোক, আমরা আশাহত না হয়ে আশাবাদী হতে চাই। আশাবাদী না হলে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ কঠিন হয়ে যাবে। একথা ঠিক যে, কাজটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ফেলে রাখা যাবে না। জিএসবি সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে গভীরতার লোহার খনি লাভজনক হবে কিনা? আর যে পদ্ধতিতে ১৩০০ থেকে ১৬৫০ ফুট গভীরে অবস্থিত স্তর থেকে ‘আয়রন ওর’ তোলা সঠিক ও নিরাপদ হবে, সেটিই করতে হবে। এর থেকে অধিক ভূ-গভীর থেকেও লৌহ খনিজ তোলার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন— বর্তমানে সুইডেনে কিরুনা আন্ডারগ্রাউন্ড আয়রন ওর মাইনে ২ হাজার মিটার নিচ থেকেও সর্বাধুনিক উপায়ে লৌহ খনিজ তোলা হচ্ছে।

বর্তমানে এমনিতেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে চলেছে। নতুন খনি আবিষ্কারকে বড় চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি অবলম্বন করতে হবে। অতীতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে চালু করার আয়োজনের পরে আন্দোলনে তা বাতিল হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য ওপেনকাস্ট মাইন বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি খনন দেশের জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে কি-না ভাবতে হবে।

২০০৫ সালে নাইকোর গ্যাস কূপ খননে অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে পরপর দুই দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দেশের গ্যাস সম্পদ ও গ্যাসফিল্ড এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। পরে সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাটি বিচারধীন রয়েছে। টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড অগ্নিকাণ্ডের ১৫ বছর পরও সুনামগঞ্জের ওই এলাকার নারী, পুরুষ ও শিশুরা এখনো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। স্থানীয়রা আর্সেনিক দূষণ, অকাল গর্ভপাত, চোখে কম দেখা, চর্মরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত গ্যাসফিল্ড এলাকার টেংরা, গ্রিসনগর, আজমপুর, টিলাগাঁও ও আলীপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। টিউবওয়েলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের জন্য আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া বর্তমানেও ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে।

গতানুগতিকভাবে নতুন সব খনিকেই খুব উন্নত, খুব ভালো বলা হয়। পরবর্তীকালে জটিল ও দুর্বোধ্য কোনো চুক্তিতে বিদেশি কোম্পানি কাজ পায়। আর বিদেশি কোম্পানি তখন খনিজ সম্পদের মান ও লাভক্ষতি নিয়ে নানা তালবাহানা করে থাকে। এ দিকগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ আর গবেষণার অভাবেই অপার সম্ভাবনার সব সম্পদ উত্তোলিত হচ্ছে না। খেয়াল রাখতে হবে এটা যেন টেংরাটিলা গ্যাস খনির মতো না হয়। সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি-অপচয় ও অস্বচ্ছতার দরজা খোলা থাকা কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সেক্টরে বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত আছে।

সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কেনাকাটা নিয়ে যা ঘটেছে, তা অকল্পনীয় সমুদ্রচুরির ঘটনা! ওই প্রকল্পের কেনাকাটায় যে দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। প্রকল্পের শুরুতেই অতি সাধারণ কেনাকাটায় এত বেশি দুর্নীতি হয়েছে যে, কেনাকাটার তালিকাটির প্রতি কারো নজর পড়লে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন। রূপপুরে ‘বালিশ-কেটলির’ উপাখ্যান পুরো প্রকল্পে সম্ভাব্য অনিয়মকে ‘হিমশৈলের চূড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন। আমাদের নৈতিক চরিত্রের এতটাই অবক্ষয় হয়েছে যে, দুর্নীতিতে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা অন্ধ হয়ে গেছেন। তারা রাতকে দিন বানাচ্ছেন আর দিনকে রাত! না হলে একটি বালিশ কিনতে তাদের ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে! যে যেখানে পারছে লুটে নিচ্ছে। সবাই ধরে নিয়েছে সরকারি তহবিল তছরুপ করলে কিছু হয় না। আগেও কিছু হয়নি। এখনো কিছু হবে না।

অতীতেও বাংলাদেশে দুর্নীতির যে সামগ্রিক চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা এক কথায় ভয়াবহ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান এবং একমাত্র অন্তরায় দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সরকারি ‘সু-শিক্ষিত’ প্রশাসন। অশিক্ষিত লোকের চেয়ে শিক্ষিত লোকেরাই দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। রূপপুর তার একটি উদাহরণ মাত্র। এ সমাজ পেটের দায়ে একজন চোরকে যতটা অবজ্ঞা করে, তার কিছুমাত্রও যদি এই ‘শিক্ষিত’ চোরদের করত, তবে দেশে চুরি-চামারি অনেক কম হতো।

দেশের প্রথম লোহার খনির আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু এর যথাযথ উদঘাটন যদি না করা যায়, তাহলে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। লোহার খনি আবিষ্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞে মেধা, নিরলস পরিশ্রম ও কারিগরি সহায়তাসহ যাদের বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ নির্দেশনায় সফল একটা পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে- সেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী, পরামর্শক ও সংশ্লিষ্টজন ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষী হয়ে থাকবেন।

মোহাম্মদ  আবু  নোমান        

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads