• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
কাশ্মীর সংকটের সমাধান জরুরি

ফাইল ছবি

মুক্তমত

কাশ্মীর সংকটের সমাধান জরুরি

  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০১৯

বর্তমান বিশ্বে যতগুলো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল রয়েছে, তার মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলা হয়। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, অবস্থানগত কারণেও কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত  ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে তিনটি যুদ্ধ। বর্তমানে তিনটি দেশ কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ শাসন করছে। ভারত শাসন করছে জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা, লাদাখ ও সিয়াচেন হিমবাহ। পাকিস্তান শাসন করছে আজাদ কাশ্মীর ও গিরগিট বাল্টিস্থান এবং চীন শাসন করছে ডেমচক জেলা, শাকসগাম উপত্যকা এবং আকসাই অঞ্চল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাশ্মীরে শান্তি কিংবা স্থিতিশীলতা আজো ফেরেনি।

মাঝে মাঝেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভারতের মুকুট হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংঘটন জইশ-ই-মোহাম্মদের চালানো হামলায় ৪৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর এত সেনা প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি। এতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভারত ও পাকিস্তান। এই হামলাটি এমন সময় সংঘটিত হয় যখন সামনেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন ছিল। এতে করে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যার পুরো সুবিধাটাই যায় মোদির ঘরে। বিশেষত যখন গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে মোদি অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল।

মোদি বরাবরই ভারত তার হাতে সব থেকে নিরাপদ বলে দাবি করেন। এর আগে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতশাসিত কাশ্মীরের উরি সেনা ক্যাম্পে জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে তার নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। তখন ভারতীয় কমান্ডোরা পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে তিন কিলোমিটার ভেতরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কখনো ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানেনি। তারা হয় খরহব ড়ভ ঈড়হঃৎড়ষ-এর নিজেদের অংশে রয়েছে অথবা কাশ্মীরের অমীমাংসিত অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে। এবারই প্রথম ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমানবাহিনী খরহব ড়ভ ঈড়হঃৎড়ষ পার হয়ে পাকিস্তানের ৮০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে বালাকোটে হামলা চালায়। ১৯ মিনিটের সেই অভিযানে ভারতীয় বিমানবাহিনী ৬টি (১ হাজার কেজি) বোমা বর্ষণ করে। নয়াদিল্লি দাবি করে, ওই হামলায় ৩০০ জঙ্গি ও তাদের ২৫ প্রশিক্ষক নিহত হয়েছে। পরবর্তীকালে ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। ভারত দাবি করে তারা পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও পাকিস্তান বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। অন্যদিকে ভারতের মিগ-২১ বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে উইং কমান্ডার অভিনন্দন প্যারাসুটের মাধ্যমে বিমান থেকে সফলভাবে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন এবং পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু কাশ্মীরে অবতরণ করেন। প্রথমে ভারত পাইলটের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে নেয়। অবশেষে আটকের ৪৮ ঘণ্টা পর ভারতের পাইলটকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান। এতে করে পরিস্থিতি একটু শান্ত হয় এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হন।

কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরের মাধ্যমে প্রবাহিত পানি ভারতের প্রায় এক বিলিয়ন মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করে। আবার পাকিস্তানও তার কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য এ অঞ্চল থেকে প্রবাহিত পানির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস। আবার পর্যটন স্থান হিসেবে কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত  রাজ্যটি পাহাড়, ঝরনা ও তুষারপাতের জন্য পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। কাশ্মীর ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উঁচু পাহাড়ি এলাকা, ঘন বনভূমি, শীতকালের ঠান্ডা আবহাওয়া ভারতের সমভূমিতে অনুপ্রবেশকারীদের বাধার সৃষ্টি করে। তাই ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই চায় কাশ্মীর তাদের সঙ্গে থাকুক। কিন্তু কাশ্মীরের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে দেশ দুটি এখনো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।

যখনই দেশ দুটি কোনো অভ্যন্তরীণ সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, তখনই তারা এই ইস্যুটিকে ব্যবহার করে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানে হামলার পর রাজস্থানের চুরু এলাকায় এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘দেশ ও জাতি এখন নিরাপদ হাতে, কারো সামনে মাথানত হতে দেব না।’ গত নির্বাচনে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে দিল্লির মসনদে বসেন মোদি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে নোট বাতিল, রাফায়েল চুক্তি, ঋণ শোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যা, কর্মসংস্থানের অভাব, অতি মাত্রায় সামপ্রদায়িকতা বৃদ্ধি ও রাম মন্দির নির্মাণ না করাসহ বিভিন্ন কারণে মোদি সরকার বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। ঠিক এ সময় পুলওয়ামায় হামলা মোদিকে বিরোধীদের উত্তর দেওয়ার জন্য শক্তি জোগায়। কারণ ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসীরা হামলা চালালে ভারতের তৎকালীন সরকার পাকিস্তানের বিপক্ষে কেনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি, যা উরিতে আর পুলওয়ামায় হামলার পর মোদি সরকার নিয়েছেন। স্বভাবতই এটি দেশবাসীর মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। আর লোকসভা নির্বাচনে এটি একটি বিরাট প্রভাবক হিসেবে কাজ  করেছে।

১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫ এবং সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে যে তারা আবার এই একই ইস্যুতে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী। তাই দেশ দুটির মধ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ বাধুক তা কারো কাম্য নয়। ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে একটি সুষ্ঠু সমাধানে আসতে পারলে কাশ্মীরিদের যেমন শান্তি মিলবে, তেমনি চিরবৈরী দেশ দুটির মধ্যেও আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

লেখক : শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads