• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং যুক্তফ্রন্টের ভাঙন

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং যুক্তফ্রন্টের ভাঙন

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০১৯

গত সপ্তাহের নিবন্ধে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে পূর্ববাংলা প্রদেশে গভর্নরের শাসন জারি করার কথা জানানো হয়েছে (২৯ মে, ১৯৫৪)। বিভিন্ন কারণ দেখানো হলেও অগণতান্ত্রিক ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের দাবি ও আকাঙ্ক্ষাকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়া। এর প্রমাণ মিলেছিল আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, ‘তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে আগত’ প্রদেশের নবনিযুক্ত গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার আস্ফাালন থেকে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভাসানীকে আমি গুলি করিয়া হত্যা করিব।’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ১৯৭৫, পৃ ৩৪০)। অমন ভয়ংকর হুমকির কারণ, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের আপসহীন প্রবক্তা মওলানা ভাসানীকে কোনোভাবেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরিয়ে আনা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

ষড়যন্ত্রের যে রাজনীতির কারণে পাকিস্তান থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছিল এবং প্রাসাদ রাজনীতি সর্বাত্মক হয়ে উঠেছিল, ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের পর ষড়যন্ত্রের সে রাজনীতিকেই পর্যায়ক্রমে পূর্ববাংলায়ও সংক্রমিত করা হয়। এর শিকার হতে থাকেন যুক্তফ্রন্টের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতারা। এই প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমকে বাধাহীন করার উদ্দেশ্য থেকে নেওয়া একটি পদক্ষেপ হিসেবে দলের সভাপতি মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের ২৭ মে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি হয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে গিয়েছিলেন। তিনি দেশে ফিরতে পেরেছিলেন ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল। 

ষড়যন্ত্রের পথে পূর্ববাংলার দাবি এবং অধিকার আদায়ের চেষ্টা ও আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত ও নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সব কৌশল ও কর্মকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্য ছিল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ভাঙন ঘটানো। অবিভক্ত বাংলার দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দীর্ঘদিনের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেটা সহজে সম্ভবও হয়েছিল। নির্বাচনের পর থেকে মন্ত্রিত্ব নিয়ে সংঘাতের যে সূচনা হয়েছিল, তারই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের নেতা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তার ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়।

যুক্তফ্রন্টের এই ভাঙনে দলগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর কারণ, ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের পর ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ববাংলায় গঠিত সরকার ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল। এরই পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ৩৯ জন এমএলএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) দলত্যাগ করায় দলটির পরিষদ সদস্য সংখ্যা কমে হয়েছিল ১০৪। ওদিকে গণপরিষদের ৩১টি মুসলিম আসনের নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ পেয়েছিল ১৬টি। বড় দল হলেও আওয়ামী লীগের ভাগে এসেছিল মাত্র ১২টি আসন। পরবর্তীকালে উপনির্বাচনের মাধ্যমে একটি আসন পাওয়ায় গণপরিষদে দলটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৩। সে অবস্থায় দাবি জানানো এবং আন্দোলন করা ছাড়া স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের তেমন কিছু করার থাকেনি।

যুক্তফ্রন্টের এই ভাঙন প্রাসাদ রাজনীতির ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পূর্ববাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। তারা নিজেদের নীলনকশার ভিত্তিতে শেরেবাংলা ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সাহরাওয়ার্দীর কাঁধে সওয়ার হয়ে সাফল্যের সঙ্গে পূর্ববাংলাবিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছিল। হক-সোহরাওয়ার্দীর এই সংঘাত এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল যে, পাকিস্তানের কেন্দ্র তথা কেন্দ্রীয় সরকারকে সীমাহীন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে রচিত ১৯৫৬ সালের সংবিধানের বিরোধিতা করার ব্যাপারেও এ দুই নেতা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি। পাকিস্তান গণপরিষদে সংবিধান যখন অনুমোদন করা হয় তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিরোধী দলের নেতার আসনে। অন্যদিকে ফজলুল হক ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুই প্রধান নেতার এই শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ও অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সংবিধানে পূর্ববাংলাকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। পূর্ববাংলা প্রদেশের ওপর চাপানো হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম এবং সংখ্যাসাম্য। জনসংখ্যার দিক থেকে ৫৬ শতাংশের প্রদেশ হলেও কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদে পূর্ববাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমানসংখ্যক সদস্য বা এমএনএ দেওয়ার বিধান করা হয়েছিল। সংবিধানে ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ববাংলাও তার ভাগে ১৫০টি আসন পেয়েছিল। ওদিকে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ— এই চারটি প্রদেশকে একত্রিত করে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবর্তিত হয়েছিল গণবিরোধী ‘এক ইউনিট’ ব্যবস্থা। এর ফলে প্রদেশগুলো তাদের এত বছরের পৃথক পরিচিতি ও অস্তিত্ব খুইয়ে ফেলেছিল।

সর্বাত্মক সে ষড়যন্ত্রের মুখেও আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিরাট জনসভায় ২১ দফাভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিধানসংবলিত সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানানো হয়। সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলার সব শহরে ও গ্রামাঞ্চলে সভা ও মিছিলের মাধ্যমে দাবিটি তুলে ধরতে থাকে। ১৯৫৬ সালের ১৫ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের বিরাট জনসভায় মওলানা ভাসানী প্রস্তাবিত সংবিধানকে ‘নির্যাতিত জনগণকে শৃঙ্খলিত করার এক মহাষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার’ আহ্বান জানান। অভিযোগ জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, প্রস্তাবিত সংবিধানে কেন্দ্রের হাতে সব আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে পূর্ববাংলা অর্থনৈতিক দিক থেকে অচল হয়ে পড়বে।

স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনের সে পর্যায়ে ১৯৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি কাগমারীতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, সংবিধানে স্বায়ত্তশাসনসহ ২১ দফার ভিত্তিতে সংশোধনী আনতে ব্যর্থ হলে দলের পরিষদ সদস্যরা অধিবেশন বর্জন করবেন। গণপরিষদের সংবিধানকেন্দ্রিক বিতর্কে আওয়ামী লীগের পক্ষে আবুল মনসুর আহমদ যুক্তিপূর্ণ দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো তাকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তার বিচার দাবি করেছিল। আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিরোধী দলের নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও জোরালো বক্তব্য রেখে প্রস্তাবিত সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে শেরেবাংলা ফজলুল হক তখন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর অধীনে গঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সে কারণে তিনি পূর্ববাংলার স্বার্থবিরোধী সংবিধানের পক্ষে অবস্থান নেন এবং তার কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলাম পার্টির সক্রিয় সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও সংবিধানটি অনুমোদন পেয়ে যায় (২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬)। এটাই ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান।

স্বায়ত্তশাসনের বিধানবিহীন সংবিধান অনুমোদনের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ১২ জন গণপরিষদ সদস্য ওয়াকআউট করেছিলেন। ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টি পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দু-চারটি কথা বললেও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে মন্ত্রিত্ব রক্ষার স্বার্থে বিরোধিতার পরিবর্তে সংবিধান অনুমোদনের পক্ষে ভোট দেয়। গণপরিষদে অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৫৬ সালের ২ মার্চ গভর্নর জেনারেল হিসেবে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। সংবিধান কার্যকর হয় ২৩ মার্চ। এ উপলক্ষে আয়োজিত প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানটি আওয়ামী লীগের গণপরিষদ সদস্যরা বর্জন করেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ২৬ মার্চ পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সমাবেশ। উল্লেখ্য, সংবিধান পাস হলেও আওয়ামী লীগ তার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে।

ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পূর্ববাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ছিল দল গঠনের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি। এ প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন-নিপীড়নসহ সর্বাত্মক প্রতিকূলতার মুখেও আওয়ামী লীগ তার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুমোদনের সময় অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের গণপরিষদ সদস্যরা প্রকৃতপক্ষে এ ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন দাবি ও অধিকারের স্বীকৃতি না থাকার কারণে তারা সংবিধানটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানত ফজলুল হকসহ একদল রাজনীতিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় পূর্ববাংলাকে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল।

এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধেই আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন করেছেন। সে আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীকালে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads